বেইলি রোডের ঘটনা অবহেলা নয়, এটি বেআইনি কার্যকলাপ

‘নিমতলী থেকে বেইলি রোড: অগ্নিকাণ্ডের বাস্তবতা ও করণীয়’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় (বাঁ থেকে) সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ, কৃষ্ণা দেবনাথ, শামসুল হুদা, আলী আহমেদ খান, ইকবাল হাবিব ও সারা হোসেন। ঢাকা, ৯ মার্চ
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

বেইলি রোডে আটতলা ভবনে আগুনে মৃত্যুর ঘটনায় অবহেলার অভিযোগ এনে মামলা করেছে পুলিশ। তবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ মনে করেন, অবহেলাজনিত নয়; বেআইনি কার্যকলাপের অভিযোগে মামলা হওয়া উচিত ছিল। কারণ, এটি অবহেলা নয়; হত্যাকাণ্ড। এখানে আইনের ব্যত্যয় হয়েছে। আইনবহির্ভূতভাবে কাজ হওয়ার কারণেই আজকে এই পরিণতি।

‘নিমতলী থেকে বেইলি রোড: অগ্নিকাণ্ডের বাস্তবতা ও করণীয়’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ এমন অভিমত দিয়েছেন। শনিবার বিকেলে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত ওই সভায় তিনি বলেন, ‘আপনারা বলছেন অবহেলাজনিত, আমি বলব অবহেলাজনিত নয়। কোনো অবহেলাজনিত মামলা আপনারা করবেন না। নিমতলী থেকে বেইলি রোড—কোনটি অবহেলাজনিত? আমার তো মনে হয় না। আমি বলব, বেআইনি কার্যকলাপজনিত। অবহেলাজনিত মামলা করে সময় নষ্ট করার দিন বোধ হয় শেষ হয়ে গেছে। আপনারা বেআইনি কার্যকলাপজনিত মামলা করেন। এতে দণ্ড হবে, অর্থদণ্ড হবে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে।’

গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে ভয়াবহ আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। এ প্রসঙ্গে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ বলেন, দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, ওই ভবনে রেস্টুরেন্ট (রেস্তোরাঁ) করারই কথা ছিল না। শুরুতেই এগুলো বন্ধ করা উচিত ছিল। ওই ঘটনার (আগুনে মৃত্যু) জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী। প্রথমে মালিকপক্ষ দায়ী, তারপর নকশা পাস করা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ (রাজউক)দায়ী। বেআইনিভাবে যারা ইমরাত নির্মাণ করছে, বেআইনিভাবে যারা নকশা পাস করছে, তাদেরকে আগে ধরতে হবে। বেআইনি কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে, তারা কেন বিষয়গুলো দেখবে না, সে প্রশ্ন তোলেন তিনি।

বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের মতোই ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খানও মনে করেন, ভবনে আগুনের ঘটনায় তদারকির দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থাগুলোকে দায় নিতে হবে। সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে। সংস্থাগুলো কী কারণে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না, সেগুলো দেখতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

বেইলি রোডের বাসিন্দা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সারা হোসেন। মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, একটি ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর অনেকগুলো বিশেষ অভিযান শুরু হয়ে যায়। কিছুদিন এই অভিযান চলে। তারপর থেমে যায়। এভাবে কোনো সমস্যার সমাধান হয় না বরং আরেক ধরনের সমস্যা তৈরি হয়।

আরও পড়ুন

এই মতবিনিময় সভা যৌথভাবে আয়োজন করে বেসরকারি সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিস (বিলস), শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরাম (এসএনএফ) ও সেইফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি (এসআরএস)। সভার শুরুতে ঢাকায় বিভিন্ন সময় অগ্নিকাণ্ডে মৃত ব্যক্তিদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিকের গুদাম থেকে ছড়িয়ে পড়া আগুনে মারা যান ১২৪ জন। আর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনে মারা যান ৭১ জন।

‘দুর্নীতির নেশা’

রাজউকের করা একটি জরিপের তথ্য উল্লেখ করে মতবিনিময় সভায় স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত যেসব ভবন নির্মিত হয়েছে, তার প্রায় ৯৬ শতাংশ অবৈধ। রাষ্ট্র দায় না নিতে নিতে এমন অবস্থার তৈরি হয়েছে যে কেষ্ট ব্যাটাই চোর। যেন জনগণেরই সব দোষ।

ভবন নিরাপদ করতে একটি টাস্কফোর্স গঠনের দাবি জানিয়ে ইকবাল হাবিব বলেন, ভবনের নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকারের সব সংস্থাকে ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত করতে হবে। অননুমোদিত সব ভবন হয় আইনের আওতায় আসবে, নয়তো সেগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। এই দৃঢ়তা দেখাতে হবে। রানা প্লাজা ঘটনার পর বস্ত্রশিল্পকে যেভাবে সুরক্ষিত করা সম্ভব হয়েছে, সেভাবে ভবনগুলোকেও নিরাপদ করার পদক্ষেপ নিতে হবে।

বড় কোনো দুর্ঘটনার পর সরকারি সংস্থাগুলো যে ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে, তাতে পরিকল্পনা বা সমন্বয় কোনোটাই থাকে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, ‘তখন প্রতিটি সংস্থা গিয়ে বলবে, আপনার ভবনে এটা হয় নাই, ওটা হয় নাই। অথচ যখন নির্মাণ (ভবন) হয়, তখন তারা এসব নিশ্চিত করে না।...কারণ তাদের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব আছে এবং দুর্নীতির একটা নেশা আছে। দুর্নীতির নেশার কারণে তারা এক হয়ে অভিযান পরিচালনা করে না। তারা আলাদাভাবে যাবে এবং আলাদাভাবে মানুষকে হয়রানি করবে।’

আরও পড়ুন

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘রাজউক বলে ভবন নিয়ম মেনে হয়নি। তাহলে তারা এত দিন কী করছিল? তাদের কাজ কী? তারা বলে, জনবল নাই। কিন্তু ঝামেলা পাকানোর সময় তাদের জনবল ঠিকই থাকে। রাজউকের কাছে তথ্য চাইলে দিতে চায় না, ১০ জায়গায় ঘোরাবে, সে কাজ করার সময় তাদের জনবলের ঘাটতি থাকে না।’

অংশীজনদের নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে তিন মাসের মধ্যে রাজধানীর সব ভবন পরীক্ষা–নিরীক্ষা করার দাবি জানিয়ে মতবিনিময় সভায় সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, রাজউক একটি চেক লিস্ট (করণীয় তালিকা) দিয়ে বলতে পারে এই জিনিসগুলো নিরাপদ করেন। এক মাস সময় দিয়ে সেই চেক লিস্ট মানা হলো কি না, সেটি যাচাই করতে পারে তারা। কিন্তু এই কাজটি রাজউক করে না।

‘বিপর্যয়ের পর্যায়ে’

বেইলি রোডের ঘটনার পর নিজের ভবনটি নিরাপদ কি না, তা নিজ উদ্যোগে কতজন মালিক যাচাই করেছেন, সেই প্রশ্ন রাখেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের যুগ্ম মহাপরিদর্শক প্রকৌশলী ফরিদ আহম্মদ। তিনি বলেন, অগ্নিঝুঁকি এড়াতে ভবনমালিকদের সচেতনতা দরকার।

জনবলসংকটের কারণে প্রতিটি ভবনমালিককে অগ্নিনিরাপত্তাসহ অন্য বিষয়গুলো মানতে বাধ্য করা যাচ্ছে না বলে জানান ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক মো. আনোয়ারুল হক।

সভায় আরও বক্তব্য দেন বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইয়াসির আরাফাত খান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আয়েশা আক্তার ও এস হাসানুল বান্না, ব্লাস্টের গবেষণা কর্মকর্তা ফাহাদ বিন সিদ্দিক, অগ্নিকাণ্ডে স্বামী হারানো ফাতেমা আক্তার প্রমুখ। সভায় সমাপনী বক্তব্য দেন এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা। সঞ্চালনা করেন বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ। স্বাগত বক্তব্য দেন ব্লাস্টের পরিচালক মো. বরকত আলী।

এর মধ্যে বুয়েটের সহযোগী অধ্যাপক ইয়াসির আরাফাত খান বলেন, দেশে বছরে প্রায় ২৪ হাজার অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। কোনো বহুতল ভবনের বহির্গমন পথ (সিঁড়ি) বন্ধ থাকলে অথবা জরুরি পরিস্থিতিতে ব্যবহার করা না গেলে এ ধরনের ঘটনা থামবে না। তিনি বলেন, বহু স্তরে অনিয়ম হলে তা বিপর্যয়ের পর্যায়ে চলে যায়। বেইলি রোডের আগুনের ঘটনাটি তার উদাহরণ।

আরও পড়ুন