পেছন থেকে লোকজন চিৎকার করলেও গাড়ি চালিয়ে যান ঢাবির সাবেক শিক্ষক জাফর শাহ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দুর্ঘটনায় নিহত রুবিনা আক্তারের ভাই মিলনের আহাজারি। আজ শুক্রবার বিকেলে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, জরুরি বিভাগ
ছবি: জাহিদুল করিম

প্রাইভেট কারটি পেছন থেকে মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেওয়ার পর আরোহী দুজন দুই দিকে ছিটকে পড়েন। মোটরসাইকেলের পেছনে বসে থাকা রুবিনা আক্তার রাস্তায় পড়ার পর ওই প্রাইভেট কারের নিচে চাপা পড়েন। তাঁর পোশাক প্রাইভেট কারের বাম্পারে জড়িয়ে তিনি গাড়ির নিচে আটকা পড়েন। মোটরসাইকেলটি চালাচ্ছিলেন তাঁর দেবর নুরুল আমিন। তিনি যখন নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ান, তখন দেখতে পান তাঁর ভাবি গাড়ির নিচে, সে অবস্থায় বেপরোয়া গতিতে ছুটে চলেছে গাড়িটি।

এ ঘটনা আজ শুক্রবার বেলা তিনটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে টিএসসি অভিমুখী সড়কে। ভাবির এ অবস্থা দেখে গাড়ির পেছনে ছুটতে থাকেন নুরুল আমিন। এ সময় টিএসসি এলাকায় থাকা ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকানিদেরও চোখে পড়ে ঘটনাটি। এভাবে একজন মানুষকে নিচে আটকে গাড়ি চালিয়ে আসতে দেখে তাঁরা এগিয়ে যান। গাড়িটির পিছু নিয়ে থামানোর জন্য চিৎকার করতে থাকেন তাঁরা। এরপরও চালক থামেননি। প্রায় দেড় কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে নীলক্ষেত মোড় ঘুরে তিনি পলাশী অভিমুখী সড়ক ধরেছিলেন। সেখান থেকে আর পালিয়ে যেতে পারেননি। পিছু নেওয়া মানুষের সঙ্গে পুলিশের একটি গাড়িও এগিয়ে যায় ওই নারীকে উদ্ধারে। নীলক্ষেত মোড় পার হওয়ার পর পুলিশের গাড়িটি সামনে গিয়ে দাঁড়ালে প্রাইভেট কার নিয়ে আর সামনে এগোতে পারেননি চালক।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গাড়ির নিচে চাপা পড়ে নিহত নারীর স্বজনদের আহাজারি। আজ শুক্রবার বিকেলে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, জরুরি বিভাগ
ছবি: জাহিদুল করিম
আরও পড়ুন

এ সময় পুলিশ রুবিনাকে (৪৫) উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। বিক্ষুব্ধ জনতা মারধর করেন মোহাম্মদ আজহার জাফর শাহকে। পঞ্চাশোর্ধ্ব জাফর শাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। একাডেমিক কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে ২০১৮ সালে তাঁকে চাকরিচ্যুত করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তাঁর এভাবে মানুষকে গাড়ির নিচে আটকে গাড়ি চালিয়ে যাওয়া ও ধরা পড়ার বিস্তারিত জানিয়েছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ কর্মকর্তারা।

গাড়ির বাম্পারে কাপড় জড়িয়ে আটকা পড়েন ওই নারী, এভাবে তাঁকে টেনে নিয়ে যান চালক
ছবি: সংগৃহীত

পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মো.শহিদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, জাফর শাহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এখন তাঁর কথা বলার মতো অবস্থা নেই। তাঁর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কাউকে পাওয়া যায়নি। একটি মোবাইল নম্বর ছিল। সেটাও এখন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

জাফর শাহ কিছুটা সুস্থ হলে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে জানিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা শহিদুল্লাহ বলেন, তিনি কেন এমনটি করলেন, তা খতিয়ে দেখা হবে। তাঁর বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নিহত রুবিনা আক্তার
ছবি: সংগৃহীত

ঘটনার ঘণ্টাখানেক পর বিকেল ৪টার দিকে নীলক্ষেতের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ থেকে পলাশী অভিমুখী সড়কে গিয়ে দেখা যায়, রুবিনার ব্যবহৃত হেলমেটের ভাঙা দুটি অংশ পড়ে রয়েছে। রক্তের ছোপ ছোপ দাগ ছিল আশপাশে।

আরও পড়ুন

দুর্ঘটনার খবর শুনে রুবিনার স্বজনেরা ঢাকা মেডিকেলে ছুটে আসেন। তাঁরা জানান, রুবিনার স্বামী ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান দুই বছর আগে মারা যান। অষ্টম শ্রেণিতে পড়া একমাত্র ছেলে রোহানকে নিয়ে তেজগাঁওয়ের হোন্ডা গলিতে বসবাস করতেন রুবিনা। ওই বাসা থেকেই দেবর নুরুল আমিনকে নিয়ে হাজারীবাগে বাবার বাড়ি যাচ্ছিলেন। যাওয়ার পথে দুর্ঘটনা ঘটে। রুবিনা একজন গৃহিণী। স্বামীর মৃত্যুর পর বাড়িভাড়া ও স্বজনদের সহযোগিতায় ছেলেকে লেখাপড়া করাচ্ছিলেন।

আজহার জাফর শাহের গাড়ি ভাংচুর করেন বিক্ষুব্ধরা
ছবি: প্রথম আলো

রুবিনা আক্তারের দেবর নুরুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গাড়ির ধাক্কায় আমি এক পাশে পড়ে গিয়েছিলাম। নিজেকে সামলে দাঁড়ানোর পর দেখি ভাবি গাড়ির নিচে আটকা পড়েছেন। এ অবস্থাতেই গাড়িটি বেপরোয়া গতিতে সামনের দিকে ছুটে চলেছে। তখনই গাড়ির পেছনে ছুটতে থাকি। ভাবি গাড়ির বাঁ পাশের সামনের চাকা এবং পেছনের চাকার মাঝামাঝি জায়গায় আটকে ছিলেন। আর গাড়িটি বেপরোয়া গতিতে সামনের দিকে ছুটে চলছিল। একপর্যায়ে পথচারীরা গাড়িটি আটক করে।’

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরাও নুরুল আমিনের মতো একই ধরনের তথ্য দিয়েছেন। তাঁদের একজন টিএসসির পাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে ভ্রাম্যমাণ দোকানি আবদুল মালেক। তিনিও গাড়িটিকে তাড়া করেছিলেন। তিনি বলেন, গাড়িটি চালিয়ে শাহবাগ থেকে টিএসসির দিকে আসছিলেন এক ব্যক্তি। গাড়িতে আর কেউ ছিলেন না। ওই গাড়ির নিচে এক নারী আটকা পড়েছিলেন। এ সময় টিএসসি এলাকায় অনেক লোকজন ছিল। চালক হয়তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতে থাকেন। পেছন থেকে মানুষ চিৎকার করলেও চালক থামছিলেন না।