ঢাকায় জন্মনিবন্ধনের জন্য ঘুরছেন লোকজন, আবেদনেও জটিলতা

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা শাওন আহমেদ তাঁর দুই সন্তানের জন্মনিবন্ধন করতে চাইছেন। তাঁর এলাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আওতায়। কয়েক দিন ধরে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় আর আঞ্চলিক কার্যালয়ে ঘুরে ঘুরেও কোথায় গেলে জন্মনিবন্ধন করা যাবে, সে তথ্য তিনি পাননি।

গত মঙ্গলবার বেলা আড়াইটার দিকে কারওয়ান বাজারে ডিএনসিসির অঞ্চল-৫ কার্যালয়ে শাওন আহমেদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। শাওন বলেন, তিনি শুনেছেন এখন থেকে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে জন্মনিবন্ধন করতে হবে। তাঁর দুই ছেলে–মেয়ের জন্মনিবন্ধন করার জন্য ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে গিয়ে শোনেন সেখানে এখনো জন্মনিবন্ধনের কাজ শুরু হয়নি। তাঁকে আঞ্চলিক কার্যালয়ে খোঁজ নিতে বলা হয়। এ কারণে তিনি অঞ্চল-৫–এ এসেছেন। তবে কার্যালয়ের একজন কর্মী তাঁকে কোনো তথ্য না দিয়ে দরজায় সাঁটানো নোটিশ পড়ে নেওয়ার ‘পরামর্শ’ দিয়েছেন। নোটিশে লেখা, ‘জন্মনিবন্ধনের কার্যক্রম ওয়ার্ড পর্যায়ে চালু হয়েছে। জনসাধারণকে তাঁর নিজ নিজ ওয়ার্ডে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে।’

গত ৯ সেপ্টেম্বর রেজিস্ট্রার জেনারেল প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় এখন থেকে আবেদন ফরম জমা নেওয়া, সংশোধন ও সনদ দেওয়ার কাজ করবে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়। এক দিনে ১০০টির বেশি নিবন্ধন করতে পারবে না কার্যালয়গুলো।

কোথাও সার্ভার ডাউন নেই। দক্ষতার অভাবে তাঁরা নিবন্ধনের কাজ করতে পারছেন না। আর নিবন্ধন করতে পারছেন না বলে লোকজন আবেদন করতে গেলে সার্ভার ডাউন বলে ফেরত পাঠিয়ে দেন।
মো. রাশেদুল হাসান, রেজিস্ট্রার জেনারেল, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন  

তবে ডিএনসিসির মোট ৫৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে পুরোনো (১ থেকে ৩৬ নম্বর) ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়কে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কাজের দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্তের পর থেকে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয়ে নিবন্ধনের কাজ বন্ধ রয়েছে। তবে ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় এখনো কাজটি শুরু করতে পারেনি। অপর দিকে নতুন ওয়ার্ড (৩৭ থেকে ৫৪ নম্বর) কাউন্সিলর কার্যালয়ে সচিবের পদ শূন্য থাকায় সেখানে নিবন্ধনের কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। ওই ওয়ার্ডগুলো যেসব অঞ্চলে পড়েছে, সেসব আঞ্চলিক কার্যালয়ে নিবন্ধন করা যাবে। আর রাজস্বের অর্থ নিয়ে দ্বন্দ্বে দুই মাসের বেশি সময় ধরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৭৫টি ওয়ার্ডেও নিবন্ধনের কাজ বন্ধ আছে। অর্থাৎ এ সময়ে ঢাকার দুই সিটির অধিকাংশ ওয়ার্ডে নিবন্ধনের কাজ বন্ধ।

আরও পড়ুন

নিবন্ধন করতে চাওয়া মানুষদের অভিযোগ, কোথায় নিবন্ধন হবে, সেসব তথ্য প্রচারের কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় লোকজনকে নিবন্ধনের জন্য এ কার্যালয়–সে কার্যালয় ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। ভুক্তভোগী শাওন আহমেদ বলেন, ‘কোথাও কোনো তথ্য পাই না। এখানে হবে না জানলে জ্যাম (যানজট) ঠেলে আসতাম না।’

ডিএনসিসির অঞ্চল-৫–এর সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এস এম ওয়াসিমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গত ২৯ আগস্ট থেকে তাঁর কার্যালয়ে নিবন্ধনের কাজ বন্ধ আছে।

‘ইউজার আইডি, পাসওয়ার্ডে কাজ হচ্ছে না’

৭ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সচিবদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নিবন্ধনপ্রক্রিয়ার অনুমোদিত ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দেয় রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন।  

মোহাম্মদপুরের কয়েকটি এলাকা নিয়ে ডিএনসিসির ৩২ নম্বর ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সৈয়দ হাসান নূর ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড পেয়েছেন। কিন্তু সার্ভার এত ডাউন যে কাজ করতে পারছেন না।

আরও পড়ুন

আগারগাঁও, শ্যামলী ও তালতলা এলাকা অর্থাৎ ডিএনসিসির ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. ফোরকান হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ৭ সেপ্টেম্বর প্রশিক্ষণ পেয়েছেন কীভাবে ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে নিবন্ধনের কাজ করতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এক দিনও কাজ করতে পারেননি। এলাকার অনেকেই নিবন্ধনের জন্য এসে ফিরে যাচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি এর আগেও কর্তৃপক্ষকে বলেছি, যদি কাজটি আমাদের দায়িত্বে দেন, তাহলে ভালোভাবে দেন। না হলে দিয়েন না। এই সার্ভারে কোনো কাজ করতে পারছি না। আমাদের তো লোকজনের কাছে জবাবদিহি করতে হয়।’

ফোরকান বলেন, তাঁর জানামতে, মোট ৩৩টি ওয়ার্ডে ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে।  

নিবন্ধন করতে চাওয়া মানুষদের অভিযোগ, কোথায় নিবন্ধন হবে, সেসব তথ্য প্রচারের কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় লোকজনকে নিবন্ধনের জন্য এ কার্যালয়–সে কার্যালয় ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে।

এদিকে ডিএনসিসির ৫১ নম্বর (উত্তরার কয়েকটি এলাকা) ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ শরীফুর রহমান এবং ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের (ভাটারা এলাকা) কাউন্সিলর মো. নজরুল ইসলাম ঢালী বলেছেন, কার্যালয়ে সচিব না থাকায় তাঁরা ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড পাননি। গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে তাঁরা বলেন, ১৮টি নতুন ওয়ার্ডে সচিব নেই। সচিব কবে নিয়োগ হবে, সেটা তাঁরা জানেন না।

ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন বলেন, ১৮টি ওয়ার্ডে অর্থাৎ ৩৭ থেকে ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডে আগের মতো নিজ নিজ আঞ্চলিক কার্যালয়ে গিয়ে নাগরিকদের নিবন্ধন করার ব্যবস্থা আছে। তবে বেশির ভাগ সময় ‘সার্ভার ডাউন’ থাকায় সেখানেও নিবন্ধনের কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। অনেককে ফিরে যেতে হয়।
অভিযোগের বিষয়ে রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসান গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, কোথাও সার্ভার ডাউন নেই। দক্ষতার অভাবে তাঁরা নিবন্ধনের কাজ করতে পারছেন না। আর নিবন্ধন করতে পারছেন না বলে লোকজন আবেদন করতে গেলে সার্ভার ডাউন বলে ফেরত পাঠিয়ে দেন। প্রতিটি বিষয় নিয়ম মেনে করতে হবে, তা না হলে সফটওয়্যারে তাঁরা কাজ করতে পারবেন না।

তবে দক্ষতা না থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ওয়ার্ড কাউন্সিলররা।


নিবন্ধন নেওয়া ব্যক্তিদের তথ্য ফাঁস হওয়ার ঘটনা প্রকাশ পেলে অনলাইনে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের জন্য ব্যক্তির নিজে আবেদন করার সুযোগ গত ১ আগস্ট থেকে বন্ধ করে দেয় রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়। তবে ৩১ আগস্ট আবার সেই সুযোগ চালু করা হয়েছে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ।

তবে অনেক ব্যক্তি মুঠোফোনে ও সরাসরি প্রথম আলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে অভিযোগ করেছেন, তাঁরা নিজে আবেদন করতে পারছেন না। এ ছাড়া মা-বাবার জন্মসনদ লাগার বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া হয়েছিল মাঝে। সেটা নিয়ে প্রথম আলোতে গত বছরের ১৫ আগস্ট ‘জন্মনিবন্ধনে মা-বাবার সনদ আর লাগবে না’ শিরোনামে প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়েছিল। তবে মা-বাবার সনদের বিষয়টি আবেদনে আবার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

এ বিষয়ে রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসান গত সোমবার বলেন, নিজে আবেদন করা যাচ্ছে। যাঁরা পারছেন না, তাঁরা ঠিকভাবে আবেদন করছেন না। আর নিবন্ধনে দ্বৈততা পরিহারে মা-বাবার জন্মসনদের বাধ্যবাধকতা থাকবে বলে তিনি জানান।