গাবতলী হাটের ইজারা নিয়ে ‘স্বেচ্ছাচারিতায়’ ডিএনসিসির ক্ষতি সাড়ে ৫ কোটি টাকা

রাজধানীর গাবতলী পশুর হাট। গতকাল মঙ্গলবার এই হাটে কোরবানির পশু বিক্রি শুরু হয়েছেছবি: তানভীর আহাম্মেদ

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) একমাত্র স্থায়ী পশুর হাট গাবতলী হাট ইজারা দেওয়া হয় বাংলা সন অনুযায়ী এক বছরের জন্য। চলতি বাংলা সনের জন্য প্রথম দফায় দরপত্র আহ্বান করে হাটের জন্য সর্বোচ্চ দর পাওয়া যায় ২২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। তখন দরপত্র আহ্বানে ‘প্রক্রিয়াগত ভুল’ দেখিয়ে সর্বোচ্চ দরদাতাকে ইজারা না দিয়ে খাস আদায়ের সিদ্ধান্ত দেন ডিএনসিসি প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ।

এক মাসের বেশি সময় খাস আদায় করানোর পর হাট ইজারা দিতে দ্বিতীয় দফায় দরপত্র আহ্বান করে ডিএনসিসি। এ দফায় প্রথমবারের চেয়ে বেশি দর পাওয়া যায়। কিন্তু সর্বোচ্চ দরদাতা প্রস্তাবিত অর্থ পরিশোধে অপারগতা প্রকাশ করেন। শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতাকে ১৫ কোটি ৭১ লাখ টাকায় হাটের ইজারা দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন

এতে গাবতলী হাট ইজারায় ডিএনসিসির ৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। যদিও এক মাসের বেশি সময় (১৫ এপ্রিল থেকে ১৮ মে পর্যন্ত) খাস আদায় করে ডিএনসিসি এই হাট থেকে ৯৮ লাখ ৪ হাজার টাকা আদায় করে। নিজেদের আদায় করা এই টাকা যোগ করলেও গাবতলী হাটে সংস্থাটির আর্থিক লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় সাড়ে ৫ কোটি টাকার বেশি।

শুধু যে ডিএনসিসির আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তা নয়। কম টাকায় ইজারা দেওয়ায় রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে সরকারেরও। প্রথম দফায় সোয়া ২২ কোটি টাকায় হাটের ইজারা দিলে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও আয়কর (আইটি) বাবদ সরকারের রাজস্ব আয় হতো ৫ কোটি ৫৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতার কাছ থেকে ভ্যাট ও আইটি বাবদ সরকার পাচ্ছে ৩ কোটি ৯২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, যা ১ কোটি ৬৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা কম।

নিজেদের ও সরকারের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি ডিএনসিসির কর্মকর্তারা স্বীকার করলেও এ নিয়ে তাঁরা প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছেন না। কর্মকর্তারা বলছেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারী ও অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণেই এমন আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। প্রথম দফার সর্বোচ্চ দর দেওয়া প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দিয়ে দিলে এমন ক্ষতি হতো না।

আরও পড়ুন

প্রথম দফায় গাবতলী হাটের দরপত্র সিপিটিইউতে (আগে সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট, বর্তমান বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি-বিপিপিএ) প্রকাশ করা হয়নি, এমন কারণ দেখিয়ে বাতিল করা হয়েছিল। যদিও দেশের কোনো হাটবাজারের ইজারার বিজ্ঞপ্তি সিপিটিইউর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয় না, সেই সুযোগও নেই।

সাজুই পেলেন হাটের ইজারা

গাবতলীর পশুর হাটের সরকার নির্ধারিত দর ১৪ কোটি ৬১ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। হাট ইজারা দিতে গত ৩ মার্চ প্রথম দফায় দরপত্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। তখন সর্বোচ্চ দর পাওয়া যায় সোয়া ২২ কোটি টাকা। এ দর দিয়েছিল মেসার্স আরাত মোটরের স্বত্বাধিকারী আরাত হানিফ। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি সর্বোচ্চ দরদাতা আরাত মোটরকে ইজারা দিতে সুপারিশ করেছিল। কিন্তু ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ তখন খাস আদায়ের সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন।

এ বিষয়ে প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, হাট ইজারার দরপত্রপ্রক্রিয়া যথাযথ পদ্ধতিতে হয়নি। স্থানীয় সরকার বিভাগের ইজারা-সম্পর্কিত নীতিমালায় দরপত্রের বিজ্ঞপ্তিটি সিপিটিইউর ওয়েবসাইটে প্রকাশের বিধান থাকলেও তা করা হয়নি।

আরও পড়ুন

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তখন ডিএনসিসির একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছিলেন, প্রশাসকের পছন্দের ব্যক্তি সর্বোচ্চ দরদাতা হতে না পারায় দরপত্র আহ্বানে প্রক্রিয়াগত ভুল দেখিয়ে ইজারার পরিবর্তে খাস আদায়ের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়।

গত ২৩ এপ্রিল গাবতলী হাটে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ডিএনসিসির একজন কর্মী থাকলেও হাটে হাসিল আদায় করছিলেন রাইয়ান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ও ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সাইদুল ইসলামের লোকজন। সাইদুল মূলত দারুস সালাম থানা বিএনপির আহ্বায়ক এস এ সিদ্দিক ওরফে সাজুর ঘনিষ্ঠ বলে জানান দলটির স্থানীয় নেতারা।

গত ২২ মে দ্বিতীয় দফায় গাবতলী হাটের জন্য ইজারা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। দরপত্র খোলা হয় গত ২৮ এপ্রিল বিকেলে। এ দফায় হাটের জন্য সর্বোচ্চ ২৫ কোটি টাকার দর প্রস্তাব পাওয়া যায়। দরটি দেয় টিএইচ এন্টারপ্রাইজ। মালিক আলী হায়দার।

জমা দেওয়া চারটি দরপত্রের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দর ১৫ কোটি ৭১ লাখ টাকার প্রস্তাব আসে এরফান ট্রেডার্সের কাছ থেকে। এর মালিক দারুস সালাম থানা বিএনপির আহ্বায়ক এস এ সিদ্দিক ওরফে সাজু। বিএনপির এই নেতাকেই ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজের পছন্দের ব্যক্তি বলে অভিযোগ করেছিলেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। শেষ পর্যন্ত গাবতলী হাটের ইজারা সাজুকেই দেয় ডিএনসিসি।

আরও পড়ুন

অপারগতা জানিয়ে টিএইচের চিঠি

২৫ কোটি টাকা দর পেয়েও সর্বোচ্চ দরদাতাকে ইজারা না দেওয়া নিয়ে ডিএনসিসির সম্পত্তি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, টিএইচ এন্টারপ্রাইজ লিখিত চিঠি দিয়ে হাট পরিচালনা করতে অপারগতা প্রকাশ করে। তাই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতাকে ইজারা দেওয়া হয়।

গত সোমবার বিকেলে ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ শওকত ওসমানের কাছে টিএইচ এন্টারপ্রাইজের দেওয়া চিঠির অনুলিপি চেয়েছিলেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। তিনি চিঠির অনুলিপি দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। পরে চিঠিটি একবার দেখতে চাওয়া হয়েছিল। তা–ও তিনি দেখাননি। এ বিষয়ে তিনি ডিএনসিসির প্রশাসক অথবা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা সচিব মুহাম্মদ আসাদুজ্জামানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান এই প্রতিবেদক। তখন তিনি নগর ভবনের আট তলায় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কক্ষে ছিলেন। সাক্ষাৎ করতে চাওয়ার বার্তা পাঠানো হলে কক্ষ থেকে ফিরে এসে এই দপ্তরের এক কর্মী বলেন, ভেতরে তিনি দাপ্তরিক কাজে ব্যস্ত। তিনি এখন সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন না।

অপারগতা জানানো চিঠির বিষয়ে টিএইচ এন্টারপ্রাইজের মালিক আলী হায়দার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরে দেখি, হাতে সময় কম। তা ছাড়া আমার তো অভিজ্ঞতা নেই এ ব্যাপারে। তারপরও কিছু লোক যথেষ্ট ইনফ্লুয়েন্স (প্রভাবিত) করছিল, টাকাপয়সা জোগাড় করে দিসিল অনেকে নানাভাবে। পরে আমি দেখি যে রিস্কটা (ঝুঁকি) বেশি হয়ে যায়। পরে আমি ছেড়ে দিলাম আরকি।’

হাট নিতে পারবেন না বলে নিজ থেকেই লিখিত দেওয়ার দাবি করেন আলী হায়দার। তবে অভিযোগ রয়েছে, তাঁকে বিভিন্ন মহল থেকে চাপ দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

‘বাধ্য হয়েছি’

সর্বোচ্চ দরদাতাকে ইজারা না দেওয়ার বিষয়ে ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ প্রথম আলোকে বলেন, টিএইচ এন্টারপ্রাইজকে প্রথমে দেওয়া হয়েছিল। তারা কিছু টাকা জমাও দিয়েছিল। তবে বাকি টাকা জমা দিতে পারছিল না। তখন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতাকে ইজারা দেওয়া হয়।

আর্থিক ক্ষতির বিষয়ে ডিএনসিসির প্রশাসক বলেন, পরিকল্পনা ছিল খাস আদায় করার। সেটা করা গেলে যে দর প্রস্তাব পাওয়া গেছে, এর চাইতে বেশি আদায় করার সুযোগ ছিল। কিন্তু কোরবানির সময় নিজেদের পক্ষে এ হাটের ব্যবস্থাপনা সম্ভব হবে কি না, সে বিষয়ে লিখিতভাবে আশঙ্কা প্রকাশ করেন ডিএনসিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘তখন আমি বাধ্য হয়েছি। কারণ, আমি একা মানুষ না। আমার টিম রয়েছে।’

তবে সর্বোচ্চ দরদাতার কাছ থেকে কিছু টাকা এবং খাস আদায় করে ১ কোটি ১০ লাখের মতো টাকা আদায় করা গেছে বলে জানান ঢাকা উত্তর সিটির প্রশাসক।

আরও পড়ুন

দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার আইনগত বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করে এভাবে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি করা কোনো অবস্থায়ই গ্রহণযোগ্য নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এ ধরনের বিচ্যুত আরও হতাশাজনক, সরকারের জন্য বিব্রতকর। এ ধরনের কার্যাদেশকে (ইজারা) কোনোভাবেই ইজারাদারের একক কারসাজির ফসল হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। বাস্তবে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের যোগসাজশ এ অনিয়মে কতটুকু ভূমিকা পালন করেছে, তা সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা উচিত। ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে—জনগণের এরূপ প্রত‍্যাশা পূরণে বর্তমান সরকারের সচেষ্ট হওয়া উচিত।