ব্যয় ৪৬ কোটি, খালি ১৫ বছর

পুরান ঢাকায় বিপুল আয়তনের এই ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতের কথা বলে।

  • সামাজিক অনুষ্ঠান কেন্দ্র, ব্যায়ামাগার, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ইত্যাদি সুবিধা নিশ্চিতের কথা বলে ভবনটি নির্মাণ করা হয়।

  • এখন চার কোটি টাকা ব্যয়ে সংস্কার করে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতের উদ্যোগ।

১৫ বছর খালি থাকার পর পুরান ঢাকার সদরঘাটের এই ভবনটি ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন
ছবি: প্রথম আলো

নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার কথা বলে ২০০৬ সালে নির্মাণ করা অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের একটি ভবন এখন খালি পড়ে আছে। যদিও এটির পেছনে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪৬ কোটি টাকা।

ভবনটি পুরান ঢাকার সদরঘাটে। ২০০২ সালে এটি নির্মাণ শুরু হয়। কাজ শেষ হয় ২০০৬ সালের দিকে। ভবনে সামাজিক অনুষ্ঠান কেন্দ্র বা কমিউনিটি সেন্টার, ব্যায়ামাগার, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও বিপণিবিতান ইত্যাদি সুবিধা থাকার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এর কিছুই হয়নি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এখন ভবনটিতে ওই সব সুবিধার ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য ভবনটি নতুন করে সংস্কার ও অন্যান্য কাজের জন্য প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছে চার কোটি টাকা।

সিটি করপোরেশন বিপুল অর্থ ব্যয়ে ভবনটি নির্মাণে যতটা আগ্রহী ছিল, ব্যবহার নিশ্চিতে ততটা তৎপর ছিল না। এবার যেন আর ফেলে রাখা না হয়।
শাহ আলম, পুরান ঢাকার বাসিন্দা

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৪–এর নির্বাহী প্রকৌশলী হারুনূর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, আগামী এক বছরের মধ্যে ভবনটি নাগরিকদের সেবা পাওয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা হবে।

অবশ্য প্রশ্ন উঠেছে, এত বছর ধরে কেন ভবনটি খালি পড়ে রইল। জনগণের টাকায় নির্মিত ভবন খালি ফেলে রাখাকে গাফিলতি বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

ভবনের ইতিকথা

পুরান ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের উল্টো দিকে ভবনটি অবস্থিত। এটি ২২ কাঠা জমির ওপর নির্মিত। ছয়তলা ভবনের সব মিলিয়ে আয়তন ৮৪ হাজার বর্গফুট।

ভবনটি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকা। সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৩ কোটি টাকা।

সিটি করপোরেশনের পুরোনো কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০০৬ সালে ভবনের নির্মাণকাজ প্রায় শেষ হয়। সে সময়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা তৈরি হয়। পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। এতে সাদেক হোসেন খোকার পক্ষে আর ভবনটি চালু করা সম্ভব হয়নি। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর ভবনটি পড়ে ছিল প্রায় ১১ বছর।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন ২০১৭ সালে ভবনটি ব্যবহার উপযোগী করার উদ্যোগ নেন। নথিপত্র বলছে, তখন ভবনটি সংস্কারে ২২ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছিল। সংস্কারের পর ভবনটিতে ‘শেখ হাসিনা জলবায়ু উদ্বাস্তু আশ্রয়কেন্দ্র ও সোশ্যাল সার্ভিস সেন্টার’ নামের একটি আশ্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন সাঈদ খোকন। এটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় সাজেদা ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি সংস্থাকে।

দক্ষিণ সিটির কর্মকর্তারা জানান, সাজেদা ফাউন্ডেশনের সঙ্গে দক্ষিণ সিটির চুক্তি ছিল এমন, আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যয়ভার ও আশ্রিতদের চিকিৎসায় প্রতিবছর ফাউন্ডশেনকে ছয় কোটি টাকা করে দেওয়া হবে। সাজেদা ফাউন্ডেশন ২০১৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পরের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণ শুরু হয়। দক্ষিণ সিটিও সাজেদা ফাউন্ডেশনকে নিয়মিত টাকা দেয়নি। এতে আশ্রয়কেন্দ্রের কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, নির্মাণের পর ১৬ বছরের মধ্যে এক বছরের মতো ভবনটি আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।

সরেজমিনে যা দেখা গেল

পুরান ঢাকার সরু গলি ও ঘিঞ্জি পরিবেশের মধ্যে সিটি করপোরেশনের ভবনটি বেশ খোলামেলা। উল্টো দিকে বুড়িগঙ্গা নদী। ৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের দ্বিতীয় তলার কিছু অংশ সিটি করপোরেশনের স্থানীয় কাউন্সিলরের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তৃতীয় তলায় আশ্রয়কেন্দ্রের বিছানাগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। বাকি তলাগুলোর দরজায় তালা ঝোলানো। ভবনটির নিচতলায় পশ্চিম দিকে একটি গণশৌচাগার রয়েছে, যা ব্যবহার করা হয়।

ভবনে দুটি লিফটও বসানো আছে। তবে সেগুলো সচল আছে কি না, তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানাতে পারেননি।

ভবনটি ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুর রহমান মিয়াজি প্রথম আলোকে বলেন, ভবনের দোতলার এক পাশে তার কার্যালয়। এর বাইরে ভবনে অন্য কোনো কার্যক্রম নেই।

নতুন উদ্যোগ, আবার ব্যয়

ভবনটি ব্যবহার করতে নতুন উদ্যোগ নিয়েছেন দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, চার কোটি টাকা ব্যয়ে সামাজিক অনুষ্ঠানের কেন্দ্র, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ব্যায়ামাগারসহ বিভিন্ন নাগরিক সুবিধার ব্যবস্থার প্রস্তাব মেয়র অনুমোদন দিলে এক বছরের মধ্যে কাজ শেষ করা হবে।

ভবনটির নতুন নাম দেওয়া হয়েছে ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন সামাজিক অনুষ্ঠান কেন্দ্র। উল্লেখ্য, মোয়াজ্জেম হোসেন সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর।

পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার এলাকার বাসিন্দা শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশন বিপুল অর্থ ব্যয়ে ভবনটি নির্মাণে যতটা আগ্রহী ছিল, ব্যবহার নিশ্চিতে ততটা তৎপর ছিল না। এবার যেন আর ফেলে রাখা না হয়।