করোনাকালে প্রাথমিক শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের ঝরে পড়ার হার বেশি। করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের আগে বাসা, স্কুল ও কোচিং মিলিয়ে একজন শিক্ষার্থী দৈনিক গড়ে ছয় ঘণ্টা পড়াশোনা করলেও করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে শিক্ষার্থীদের দৈনিক পড়াশোনার সময় দুই ঘণ্টায় নেমে আসে।
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিবিএসের প্রধান কার্যালয়ে ‘ন্যাশনাল সার্ভে অন চিলড্রেনস এডুকেশন ইন বাংলাদেশ ২০২১’ শীর্ষক জরিপ প্রতিবেদনের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানানো হয়েছে। তবে অনুষ্ঠানে করোনায় কেন মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা বেশি ঝরে পড়ল, তার কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ শিশু তহবিল-ইউনিসেফ যৌথভাবে জরিপটি পরিচালনা করে। উদ্ভাবনী প্রতিকারমূলক শিক্ষাসহ পড়াশোনার ক্ষতি দূর করতে ইউনিসেফ সরকারকে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে। দেশের ৯ হাজার খানায় এ জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে। খানাভিত্তিক এ জরিপে শুধু শিক্ষা পরিস্থিতির বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে আলোচকেরা বলেছেন, জরিপটি করোনায় দীর্ঘস্থায়ী স্কুল বন্ধের কারণে শিশুদের স্কুলে উপস্থিতি, স্কুলের বাইরে থাকা, ঝরে পড়া, শেখার ক্ষতিসহ শিক্ষার অন্যান্য ফলাফলের ওপর প্রভাব বুঝতে সাহায্য করবে এবং শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য সরকারকে পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করবে।
অনুষ্ঠানে বিবিএসের পরিচালক (ডেমোগ্রাফি অ্যান্ড হেলথ উইং) মো. মাসুদ আলম জরিপের সারাংশ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, করোনায় ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে ১৮ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। আন্তর্জাতিক জরিপ পদ্ধতি ও প্রশ্নপত্র অনুসরণ করে ২০২১ সালের ২১ ডিসেম্বর থেকে গত বছরের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত জরিপটি পরিচালিত হয়। শিশুদের পরিস্থিতির ওপর দেশের বৃহত্তম জরিপ ২০১৯ সালের বাংলাদেশ মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভের (মিকস) পদ্ধতি ব্যবহার করে করোনায় শিশুদের শিক্ষা পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে বিবিএসের ২৬টি দল খানাগুলোয় সরাসরি গিয়ে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করেছে।
অনুষ্ঠানের উন্মুক্ত পর্বের আলোচনায় একাধিক বক্তা কোন কারণে ছেলে বা মেয়েরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ল, বাল্যবিবাহের হারটা কেমন ছিল—এসব বিষয়ের তথ্য জরিপে না থাকার বিষয়টি তুলে ধরেন। অনুষ্ঠান শেষে বিবিএসের পরিচালক (ডেমোগ্রাফি অ্যান্ড হেলথ উইং) মাসুদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, আসলে এ জরিপের মূল লক্ষ্য ছিল, করোনায় শিক্ষা পরিস্থিতির তথ্য তুলে ধরা। তাই এ জরিপে কারণগুলোর সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যাবে না।
মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব শাহনাজ আরেফিন বলেন, ইউনিসেফ, বিবিএসসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো সমন্বিতভাবে করোনায় শিক্ষা পরিস্থিতির সামগ্রিক দিক নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করলে তা নীতিনির্ধারণ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বেশি সহায়ক হবে।
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাপরিচালক মো. মতিয়ার রহমান বলেন, বিবিএসের জরিপে তথ্যটা তুলে ধরা হয় যা আলোচনার খোরাক জোগায় বা বিষয়টিকে উসকে দেয়। তাই আজকের অনুষ্ঠানে কেন ছেলেরা বেশি ঝরে পড়ল বা বাল্যবিবাহ পরিস্থিতি নিয়ে সবাই তথ্য চাইছেন। তবে বর্তমানে বিবিএসকে শুধু তথ্য দিলেই চলবে না, গবেষণা করারও সময় এসেছে। জরিপের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। তথ্য নিয়ে পরবর্তীকালে গবেষণার জন্য উইং বাড়ানো, দক্ষ জনবলের নিয়োগ, অর্গানোগ্রাম পরিবর্তনসহ বিভিন্ন প্রস্তাব সরকারকে দেওয়া আছে।
অনুষ্ঠানে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, করোনায় শিখনঘাটতি কমানোর জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীরা শুধু যে করোনাকালেই ঝরে পড়েছে, তা তো নয়, করোনার আগে এবং করোনার পরেও ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। এর পেছনে অর্থনৈতিক কারণসহ বিভিন্ন কারণ আছে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে সরকার ৩৮ হাজার কোটি টাকার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। নতুন করে ৩৭ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। সরকারি–বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মোট ছয় লাখ শিক্ষককে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, করোনায় অনেক শিক্ষার্থী মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছে। প্রি-ক্যাডেট নাম দিয়ে বিভিন্ন মাদ্রাসা চলছে দেশে। কাউকে বাধা দেওয়ার জন্য নয়, একটি কাঠামোর আওতায় আনার জন্য কাজ করছে সরকার।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইউনিসেফের স্যোশাল পলিসি, অ্যানালিটিকস অ্যান্ড রিসার্চের প্রধান স্ট্যানলি গোয়াউইয়া, বিবিএসের উপমহাপরিচালক কাজী নূরুল ইসলাম, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম সচিব দীপঙ্কর রায় প্রমুখ।
জরিপের বিভিন্ন তথ্য: জরিপ বলছে, উচ্চমাধ্যমিক স্তরে (নবম থেকে দ্বাদশ) ২০১৯ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২১ সালে তা হয় ৭ দশমিক ১ শতাংশ। ছেলেদের ঝরে পড়ার হার ২০১৯ সালে ছিল ৭ দশমিক ৯ আর ২০২১ সালে ছিল ৬ দশমিক ৪। মেয়েদের ক্ষেত্রে ২০১৯ সালে ছিল ১১ দশমিক ৭ এবং ২০২১ সালে ছিল ৭ দশমিক ৮। নিম্নমাধ্যমিক স্তরে ২০১৯ সালে ছেলেদের ঝরে পড়ার হার ছিল ৩ দশমিক ৫ আর ২০২১ সালে ছিল ৫ দশমিক ৭। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে ২০১৯ সালে ছিল ৪ দশমিক ২ এবং ২০২১ সালে ছিল ৪ দশমিক ৫। প্রাথমিকেও ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২১ সালে মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা বেশি ঝরে পড়ে।
করোনার সময় শিশুদের লেখাপড়ার ওপর ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে পড়াশোনার ক্ষেত্রেও বৈষম্যের প্রভাবের বিষয়টি উঠে এসেছে জরিপে। জরিপ বলছে, করোনায় স্কুল বন্ধ থাকার সময় প্রতি পাঁচ শিশুর মধ্যে একজনের কম (১৮ দশমিক ৭ শতাংশ) অনলাইন বা দূরশিক্ষণ কার্যক্রমে পড়াশোনা করে। শহর এলাকার শিশুদের (২৮ দশমিক ৭ শতাংশ) তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় কমসংখ্যক শিশু (১৫ দশমিক ৯ শতাংশ) অনলাইন ক্লাসে অংশ নেয়। অর্থাৎ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রান্তিক পর্যায়ের শিশুরা, যাদের ইন্টারনেট ও টেলিভিশন ব্যবহারের সুযোগ সীমিত এবং যাদের বাড়িতে কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের মতো সহায়ক ডিভাইসের অভাব ছিল। সবচেয়ে কম বয়সী শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে। দূরশিক্ষণ ক্লাসে অংশগ্রহণের হার মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের (নিম্ন মাধ্যমিকে ২০ দশমিক ৩ শতাংশ ও উচ্চ মাধ্যমিকে ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ) তুলনায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের ক্ষেত্রে কম (১৩ দশমিক ১ শতাংশ) ছিল।
জরিপটি বলছে, করোনায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষায় উপস্থিতি ছিল যথাক্রমে ৮০ দশমিক ৫ শতাংশ, ৫৯ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ৫০ দশমিক ৫ শতাংশ।