ব্র্যাকের আশার উৎসবে রঙিন আর্মি স্টেডিয়াম

ব্র্যাকের আশার উৎসবের বর্ণিল আয়োজন
ছবি: সৈয়দ জাকির হোসেন

গোলাপি রঙে সেজেছে রাজধানীর বাংলাদেশ আর্মি স্টেডিয়াম। গ্যালারির চারপাশ দিয়ে সারি সারি স্টল। মাঝখানে বাঁশ, কাঠের নানা আকৃতির স্থাপনা। উত্তর প্রান্তে বিশালাকার মঞ্চ। আর তার সামনের খোলা জায়গায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা লোকশিল্পীরা ঢোল-মন্দিরা বাজিয়ে গলা ছেড়ে গাইছেন ‘গান গাই আমার মনরে বুঝাই…’। লোকজন ঘুরছেন। স্টলে স্টলে গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন। ছবি তুলছেন। জমজমাট উৎসবের আয়োজন। এই উৎসব আশার।

‘হৃদয়ে বাংলাদেশে’, ‘সম্ভাবনার শক্তি’ এবং ‘যে পৃথিবী আমরা গড়তে চাই’ এই তিন প্রতিপাদ্য নিয়ে শুরু হয়েছে ব্র্যাকের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তিন দিনের উৎসব। চলবে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে চলবে রাত ১০টা পর্যন্ত। এতে থাকছে ব্র্যাকের বহুমুখী কার্যক্রমের উপস্থাপনার সঙ্গে আবহমান বাংলার চিরায়ত লোকজ সংস্কৃতির সম্মিলন। পুঁথিপাঠ, গল্পের আসর, বায়োস্কোপ, পুতুলনাচ, শিশুদের খেলার জগৎ, আলোচনা আর সাংস্কৃতিক অনু্ষ্ঠান।

আজ বৃহস্পতিবার প্রথম দিনের উৎসবের প্রতিপাদ্য ছিল ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ।’ বেলা ১১টায় দর্শনার্থীদের জন্য স্টেডিয়ামের দরজা খুলে দেওয়া হয়।

ব্র্যাকের সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রম, সামাজিক ব্যবসা কর্মকাণ্ড, বিনিয়োগ, বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য উদ্যোগসহ দেশে-বিদেশে ব্র্যাকের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড (ইকো-সিস্টেম) নিয়ে সেজেছে উৎসব প্রাঙ্গণ। বিভিন্ন স্টল, উন্মুক্ত মঞ্চ আর শিশুদের ছবি আঁকা, জাদু পরিবেশনা, লোকগান, সামাজিক সচেতনতামূলক নাটক নিয়ে আর্মি স্টেডিয়াম হয়ে ওঠে জমজমাট।

ছবি আঁকা, জাদু পরিবেশনা, লোকগান—এমন নানা আয়োজন আছে আশার উৎসবে
ছবি: সৈয়দ জাকির হোসেন

সব বয়সের মানুষের অংশগ্রহণে মুখর ছিল উৎসবের কেন্দ্র। তাঁরা ঘুরে ঘুরে উৎসবের সব আয়োজন উপভোগ করেছেন এবং বিভিন্ন কর্মশালায় অংশ নিয়েছেন। শিশুদের স্থাপত্যবিদ্যার ধারণা দিতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আর্ককিডস’, মাসুদা খানের ‘ড্র আ ফ্রেন্ড’, আড়ংয়ের গয়না তৈরির কর্মশালা ‘জুয়েলস অব বেংগল’ এমন কর্মসূচিগুলোতে ছিল প্রচুর কৌতূহলী দর্শক।

আগে থেকেই অনলাইনে নিবন্ধনের মাধ্যমে এসব কর্মশালায় অংশগ্রহণের জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছেন আগ্রহীরা।

ব্র্যাকের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ বিভাগের প্রথন সাজেদুর রহমান প্রথম আলোকে জানালেন, সারা বিশ্বজুড়ে আশা জাগানোর ৫০ বছরের পথচলা আর বাংলাদেশের মানুষের দৃঢ়তা, সাহস ও এগিয়ে যাওয়ার শক্তিকে উদ্‌যাপন করতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই উৎসব। বাধা, বিপদ, দুর্যোগে বাংলাদেশের লড়াকু মানুষ থমকেছে, কিন্তু থামেনি। সীমাহীন সম্ভাবনায় খুঁজে নিয়েছে এগিয়ে চলার পথ। এই উৎসবের মূল অনুপ্রেরণা ও আয়োজন তাদের ঘিরেই। কোটি মানুষের জীবনের মোড় পরিবর্তনের উদাহরণ সবাইকে নিজ নিজ বাধা পেরিয়ে, স্বপ্ন জয়ের অনুপ্রেরণা দেবে এই আশা ব্র্যাকের। দর্শনার্থী উৎসব উপভোগ করছেন।
মঞ্চের মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে পাঁচটায়।

উৎসবে শিশুদের জন্য আছে বিভিন্ন আয়োজন
ছবি: সৈয়দ জাকির হোসেন

একঝলকে ব্র্যাকের যাত্রাপথ:

১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে যখন শুরু হয়েছিল নানামুখী উদ্যোগ, তখন ৩৬ বছর বয়সী স্যার ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রথম উদ্যোগ ছিল দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকা শাল্লায় ভারত থেকে ফিরে আসা শরণার্থীদের ত্রাণ ও পুনর্বাসন করা। এরপর ক্রমাগত বাংলাদেশ আর ব্র্যাক বহুক্ষেত্রেই যেন হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক মুক্তির এক ভিন্নতর যুদ্ধের ময়দানে। আজ ব্র্যাক দেশের প্রধান উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানই নয়, পরিণত হয়েছে বিশ্বের সব থেকে বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। ব্র্যাক বাংলাদেশর দেশের সীমা অতিক্রম করে তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে বহির্বিশ্বে। উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কাজ করছে ১১টি দেশে।

ব্র্যাকের এই অর্ধশতাব্দীর যাত্রাপথের প্রধান মাইলফলকগুলো তুলে ধরা হয় মাঠের মাঝখানে তৈরি করা এক স্থাপনায়। সেখানে দেখা যাচ্ছে ১৯৭৪ সালে শুরু হয়েছিল ক্ষুদ্র ঋণদানের কার্যক্রম। ১৯৭৬ সালে মানিকগঞ্জে রেশম চাষের সূচনা, ১৯৭৫ সালে গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগ চালু। ১৯৭৭ সালে শুরু হয় প্রথম গ্রাম সংগঠনের কার্যক্রম।

কারুশিল্পীদের সহায়তা ও তাঁদের পণ্যের বাজার তৈরির জন্য আড়ং চালু হয় ১৯৭৮ সালে। ডায়রিয়া প্রতিরোধের জন্য খাওয়ার স্যালাইনের প্রকল্প চালু হয় ১৯৮০ সালে, ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি মানুষকে হাতে-কলমে খাওয়ার স্যালাইন তৈরি করা শেখানো হয়। এর ফলে দেশে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার দুই-তৃতীয়াংশে নেমে আসে। ১৯৮৩ সালে হাঁস-মুরগির টিকাদান শুরু হয়। এতে গ্রামীণ নারীরা স্বাবলম্বী হওয়ার পথে অগ্রসর হন। বহু কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়।  

গোলাপি রঙে সেজেছে রাজধানীর বাংলাদেশ আর্মি স্টেডিয়াম
ছবি: সৈয়দ জাকির হোসেন

প্রাথমিক স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুদের জন্য উপ আনুষ্ঠানিক শিক্ষার কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৮৫ সালে। এর মধ্য দিয়ে এক নতুন কার্যক্রম শুরু হয়। এশিয়া ও আফ্রিকার ১৫ মিলিয়ন শিক্ষার্থী এতে অংশ নিয়েছে। মানবাধিকার ও আইনি সুরক্ষার কর্মসূচি শুরু হয় ১৯৮৬ সালে। মহিলা স্বাস্থ্য উন্নয়ন কর্মসূচি শুরু ১৯৯১ সালে, ১৯৯৩ সালে চালু হয় কিশোর-কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্র, ১৯৯৪ সালে কেনিয়াতে খোলা হয় উপ আনুষ্ঠানিক স্কুল। ১৯৯৭ সালে দেশের শহরগুলোতে বস্তিবাসী ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য শুরু হয় শহর উন্নয়ন কর্মসূচি। ডেয়ারি ও ফুড প্রোডাক্টের কার্যক্রম ১৯৯৮ সালে, ২০০০ সালে প্রতিবন্ধীদের জন্য চালু হয় কৃত্রিম পা সংযোজন কেন্দ্র। ২০০২ সালে চালু হয় অতিদরিদ্র দূর করার কর্মসূচি, একই বছর আফগানিস্তানে ব্র্যাকের কার্যক্রম চালু হয়।

উগান্ডায় ব্র্যাক যায় ২০০৬ সালে, ২০০৭ সালে অতিদরিদ্র দূর করার জন্য গ্র্যাজুয়েশন কর্মসূচির শুরু হয়। এই কর্মসূচি এত সফল হয় যে বিশ্বের ৫০টি দেশে ১৪ মিলিয়ন মানুষ এতে অংশ নিয়েছেন। ফিলিপাইনে ব্র্যাকের কাজ শুরু হয় ২০১২ সালে, পরের বছর চালু হয় সমন্বিত উন্নয়ন কর্মসূচি। তানজানিয়া ও উগান্ডায় চালু হয় প্লেল্যাব কর্মসূচি। রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের সহায়তা কর্মসূচি, করোনা মহামারির সংক্রমণ শুরুর পর ২০২০ সাল থেকে দেশের ৩৫টি জেলায় ৪১টি বেসরকারি সংস্থাকে নিয়ে চলছে ব্র্যাকের সেবাদান কর্মসূচি।