তিন মাসে ৫৮টি বিপণিবিতান পরিদর্শন, সবই ঝুঁকিপূর্ণ

পরিদর্শন করা রাজধানীর ৫৮ বিপণিবিতানের মধ্যে ৯টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ, ৩৫টি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ১৪টি মাঝারি মাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ।

ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডে নিজ দোকানের পুড়ে যাওয়া কাপড় দেখছেন এক ব্যবসায়ী
ছবি: দীপু মালাকার

চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে রাজধানীর ৫৮টি বিপণিবিতান পরিদর্শন শেষে ফায়ার সার্ভিসের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, সব কটিই অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে ৯টি বিপণিবিতান অগ্নিকাণ্ডের জন্য অতি ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করে ফায়ার সার্ভিস। বাকি ৪৯টির মধ্যে ৩৫টি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ১৪টি মাঝারি মাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ।

রাজধানীর যে ৯টি বিপণিবিতানকে ফায়ার সার্ভিস অতি ঝুঁকিপূর্ণ বলছে, তার মধ্যে রয়েছে গাউছিয়া মার্কেট, ফুলবাড়িয়ার বরিশাল প্লাজা মার্কেট, টিকাটুলির রাজধানী নিউ রাজধানী সুপার মার্কেট, লালবাগের আলাউদ্দিন মার্কেট, চকবাজারের শাকিল আনোয়ার টাওয়ার ও শহীদ উল্লাহ মার্কেট, সদরঘাটের শরীফ মার্কেট ও মাশা কাটারা ২২ মার্কেট এবং সিদ্দিকবাজারের রোজ নীল তিস্তা মার্কেট।

ফায়ার সার্ভিস পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করে এই তালিকা প্রকাশ করেছেন। গতকাল রোববার দুপুরে রাজধানীর কাজী আলাউদ্দিন রোডে ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, রাজধানীর বিপণিবিতানগুলোর অগ্নিঝুঁকির মাত্রা কেমন, সেটি নিরূপণ করা ফায়ার সার্ভিসের নিয়মিত কাজের অংশ। তবে করোনার সংক্রমণসহ বেশ কিছু কারণে ২০১৯ সালের পর ঝুঁকিপূর্ণ বিপণিবিতানের তালিকা হালনাগাদ করা হয়নি। এখন নতুন করে সেই কাজ শুরু হয়েছে। গত সাড়ে তিন মাসে ৫৮টি বিপণিবিতান পরিদর্শন করেছে ফায়ার সার্ভিস। তাতে দেখা গেছে, সব কটিই ঝুঁকিপূর্ণ।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক তাজুল ইসলাম বলেন, আগুন লাগার মূল কারণ হচ্ছে অসাবধানতা। বেশির ভাগ বিপণিবিতানের কর্তৃপক্ষ আইন মানার ক্ষেত্রে খুবই উদাসীন। অনেক ক্ষেত্রেই তারা আইন অমান্য করছে। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা মানা হচ্ছে না। কিছু ঘটনায় দেখা গেছে মূল নকশা পরিবর্তন করে বিপণিবিতান সম্প্রসারণ করা হয়েছে। আইন অমান্য করা হলেও ফায়ার সার্ভিস কারও ওপর জোর করতে পারে না। শুধু অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অনুরোধ করতে পারে ফায়ার সার্ভিস। অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে সবাইকে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি আইন মেনে ভবন নির্মাণ এবং অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার অনুরোধ জানান তিনি।

২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দুই বছর ঢাকার বিপণিবিতানগুলো পরিদর্শন করে অগ্নিঝুঁকিতে থাকা বিপণিবিতানের তালিকা করে ফায়ার সার্ভিস। ২০১৯ সালে প্রকাশ করা ওই তালিকায় ১ হাজার ৪৮টি বিপণিবিতানকে অগ্নিকাণ্ডের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৪২৮টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ। ৪ এপ্রিল আগুনে পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি বিপণিবিতানকে ওই তালিকায় অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সর্বশেষ ১৫ এপ্রিল (গত শনিবার) আগুনে পুড়ে যাওয়া ঢাকা নিউ সুপার মার্কেট (দক্ষিণ) বিপণিবিতানটিও ওই তালিকায় অতি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।

আরও পড়ুন

২০১৯ সালে তালিকা তৈরির চার বছর পরও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। উদাহরণ হিসেবে ফায়ার সার্ভিসের একজন উপপরিচালক প্রথম আলোকে বলেন, গুলিস্তানের ঢাকা ট্রেড সেন্টার বিপণিবিতানটি ২০১৯ সালে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। ওই বিপণিবিতানে অগ্নিনিরাপত্তা–ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। পুরো ভবনে বৈদ্যুতিক তার। ভবনের ভেতরেও ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক ওয়্যারিং। এমনকি কোনো কোনো স্থানে খোলা অবস্থায় বৈদ্যুতিক তার রয়েছে। যত্রতত্র অতি দাহ্য মালামাল রাখা হয়েছে পুরো বিপণিবিতানে। ভবনের চারদিকে ফুটপাতে বসেছে অসংখ্য দোকান। সেখানে উন্মুক্ত অবস্থায় বৈদ্যুতিক সংযোগ দেওয়া হয়েছে। চার বছর আগেও এই বিপণিবিতানটি একই অবস্থায় ছিল।

ফায়ার সার্ভিসের ওই কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা ট্রেড সেন্টার বিপণিবিতানে আগুন লাগার যত ধরনের অনুকূল পরিবেশ থাকা দরকার, সবই বিদ্যমান রয়েছে। আগুন লাগার পর সেটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ারও অনুকূল পরিবেশ রয়েছে এই বিপণিবিতানে। এমনকি বিপণিবিতানের দক্ষিণ-পূর্ব পাশা ভবন লাগোয়া একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারও রয়েছে, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

গতকাল বিকেলে ঢাকা ট্রেড সেন্টারে গিয়ে কথা হয় বিপণিবিতানটির উত্তর অংশের দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হুদার সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই বিপণিবিতান ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রয়েছে এটা তাঁর জানা নেই। ফায়ার সার্ভিস তাঁদের কিছু জানায়নি। তবে তিনি বলেন, কয়েক দিন আগে ফায়ার সার্ভিস এখানে পরিদর্শনে এসেছিল। পরিদর্শনের পর ফায়ার সার্ভিস তাঁদের কিছু জানায়নি। তাঁর দাবি, আগুন লাগলে নেভানোর জন্য বিপণিবিতানের দুই অংশে মোট ১৫৩টি ফায়ার এক্সটিংগুইশার (অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র) রয়েছে।

আরও পড়ুন

তবে ফায়ার সার্ভিস বলছে, ঢাকা ট্রেড সেন্টারের উত্তর ও দক্ষিণ অংশের দুটি মালিক সমিতিকেই অগ্নিঝুঁকির বিষয়টি অবগত করে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলছেন, তাঁদের পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা বাস্তবায়নে কোনো বিপণিবিতানের উদ্যোগ নেই। বারবার চিঠি দিয়ে তাগাদা দেওয়া হলেও কেউই এসব বিষয়ে আগ্রহ দেখায় না।

ফায়ার সার্ভিসের সর্বশেষ তালিকায় অগ্নিকাণ্ডের জন্য অতি ঝুঁকিপূর্ণ বিপণিবিতানগুলোর তালিকায় নিউমার্কেটের উল্টো পাশের গাউছিয়া মার্কেটের নাম রয়েছে। বঙ্গবাজারে আগুন লাগার পর এই মার্কেট পরিদর্শন করেছে ফায়ার সার্ভিসের একটি দল। পরিদর্শনকারী দলে ছিলেন ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা অঞ্চলের উপপরিচালক দিনমনি শর্মা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গাউছিয়া মার্কেটের সিঁড়িগুলোও উন্মুক্ত না। সেখানেও দোকান বসানো হয়েছে। বৈদ্যুতিক তার ঝুলে আছে যেখানে–সেখানে। এ কারণে আগুন লাগলে দ্রুততম সময়ে পুরো ভবনে তা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। এই বিপণিবিতানে অগ্নিনিরাপত্তা বলে কিছু নেই।

এ বিষয়ে গাউছিয়া দোকান মালিক সমিতির সভাপতি কামরুল হাসান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, গাউছিয়া মার্কেট অতি অগ্নিঝুঁকিতে আছে, এটা একেবারেই ঠিক নয়। তাঁর দাবি, ‘অগ্নিনিরাপত্তায় এই মার্কেট স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে দু–তিন দিন আগে ফায়ার সার্ভিস পরিদর্শন করে বলেছে, পানির রিজার্ভ ট্যাংক একটি থেকে বাড়িয়ে দুটি করতে হবে। কিছু সরঞ্জামের ঘাটতি আছে, সেগুলো তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে স্থাপন করতে হবে। এটি করার জন্য সময়ও নেওয়া হয়েছে। এখন তারা কীভাবে এটাকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ বলছে, তা বুঝতে পারছি না।’

ফায়ার সার্ভিস বলছে, রাজধানীর বিপণিবিতানগুলো অগ্নিঝুঁকিতে থাকলেও মালিকেরা আসলে উদাসীন। ঝুঁকি কমাতে কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে বরং নানা অজুহাত দাঁড় করেন। অগ্নিঝুঁকি কমাতে নিরাপত্তা সরঞ্জাম কেনাসহ নতুন করে বিনিয়োগ দরকার। এই কাজে অনাগ্রহ তাঁদের। আবার অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি শুধু সরঞ্জাম কেনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এক দোকানের জায়গায় একাধিক দোকান করা, সিঁড়ি ও মেঝেতে মালামাল রাখা, কোথাও কোথাও বেজমেন্টকে গুদাম বানিয়ে ফেলা, অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না করা—এসব বিষয়ও বড় ধরনের অগ্নিঝুঁকি তৈরি করে। বিপণিবিতানগুলোর মালিকপক্ষ এবং ব্যবসায়ী সমিতিগুলো শুধু বাণিজ্যিক স্বার্থের কারণে যদি নিয়ম না মানে, তাহলে তারা নিজেরাই নিজেদের জন্য বড় বিপদ ডেকে আনবে।