অর্থনৈতিক উন্নতিই শেষ কথা নয়। উন্নয়ন অর্থবহ হয়, যদি তা মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি করে। পরিকল্পিত কর্মসূচির মাধ্যমে আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি মানুষের মর্যাদাও বাড়ানো সম্ভব।
আজ বৃহস্পতিবার পল্লী কর্ম–সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) মিলনায়তনে ‘টেকসই উন্নয়ন, মানুষের মর্যাদা ও বেছে নেওয়ার অধিকার’ শিরোনামের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন। বইটি প্রকাশ করেছে সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা স্প্রিঙ্গার। বইটি যৌথভাবে লিখেছেন যুক্তরাজ্যের সাসেক্স ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্টের অধ্যাপক মার্টিন গ্রিলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক আফিম এম শাহান ও শুভাশিস বড়ুয়া। বইটি মূলত পিকেএসএফের ‘সমৃদ্ধি’ কর্মসূচির মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে লেখা।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ও প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলেন, উন্নয়নের লক্ষ্যের সঙ্গে মানুষের মর্যাদার বিষয়টি যুক্ত করার মধ্যে অভিনবত্ব যেমন আছে, তেমনি তা সাহসেরও বটে। মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার মতো কর্মসূচি দেশব্যাপী সম্প্রসারণ করতে চাইলে ধীরে ধীরে অগ্রসর হওয়াই ভালো।
স্বাগত বক্তব্যে পিকেএসএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নমিতা হালদার বলেন, ‘সমৃদ্ধি’ কর্মসূচি শুরু হয় ২০১০ সালে। বহুমাত্রিক দারিদ্র্য দূর করার এই কর্মসূচিটি বর্তমানে দেশের ১৯৭টি ইউনিয়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে এ কর্মসূচির জন্য ৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, সমৃদ্ধি কর্মসূচিতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ভিক্ষুক পুনর্বাসন, যুব কর্মসংস্থান, সঞ্চয় ও সমৃদ্ধ বাড়ি—এসব বিষয় বা উপাদান রয়েছে। একটি ইউনিয়নে একটি এনজিও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে। পিকেএসএফ, ইউনিয়ন পরিষদ (স্থানীয় সরকার), এনজিও ও সুবিধাভোগী পরিবারগুলো যৌথভাবে এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে। সমৃদ্ধির উপকারভোগীর সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ।
স্বাস্থ্যের ওপর কর্মসূচির কী ধরনের প্রভাব পড়েছে, তা জানাতে গিয়ে পিকেএসএফের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জমীম উদ্দিন বলেন, জাতীয়ভাবে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার (প্রতি হাজার জীবিত জন্মে) ৪৫। সমৃদ্ধির ইউনিয়নগুলোতে তা ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। জাতীয়ভাবে মাতৃমৃত্যুর হার ১৭২ (প্রতি লাখ জীবিত জন্মে)। সমৃদ্ধির ইউনিয়নগুলোতে ৮৫। একই ধরনের প্রভাব পড়েছে শিশুশিক্ষার ওপর। ৬ হাজার ১৬৭টি গ্রামের প্রতিটিতে একটি করে শিক্ষাসহায়ত কেন্দ্র আছে। প্রতিটি কেন্দ্রে একজন শিক্ষিকা। স্কুলগুলোতে ঝরে পড়ার হার শূন্য দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। জাতীয়ভাবে ঝরে পড়ার হার ৪ শতাংশ।
এসব ইতিবাচক প্রভাব ইউনিয়নগুলোর বাসিন্দাদের মর্যাদা বাড়িয়েছে কি না, তাই ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। এ বিষয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের দুই সহযোগী অধ্যাপক আফিম এম শাহান ও শুভাশিস বড়ুয়া। তাঁরা বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেই মানুষ মর্যাদা পাবে, এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। অন্যদিকে মানুষের মর্যাদা পরিমাপ করাও কঠিন।
শুভাশিস বড়ুয়া বলেন, সমৃদ্ধি কর্মসূচির কারণে স্কুল থেকে ঝরে পড়ার মতো করুন পছন্দের (ট্রাজিক চয়েস) বিষয়গুলো কমেছে। বিকল্প আয়ের সুযোগ বেড়েছে। পেশার পরিবর্তন হয়েছে। দক্ষতা লাগে, এমন পেশায় মানুষ বেশি যুক্ত হয়েছে। এটা মর্যাদা বৃদ্ধির ইঙ্গিত বহন করে। এ রকম উদাহরণ আরও আছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা পরিষদের সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরি বলেন, মানুষকে মর্যাদাবান করে তোলা সামাজিক–অর্থনৈতিক উন্নয়নের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। পিকেএসএফের সমৃদ্ধি কর্মসূচি মানুষের মর্যাদার ক্ষেত্রে ধনাত্মক প্রভাব ফেলেছে। এটি কর্মসূচির শক্তিমত্তার প্রমাণ।
দেশে ইউনিয়নের সংখ্যা ৪ হাজার ৫০০টির বেশি। সমৃদ্ধির কাজ চলছে মাত্র ১৯৭টি ইউনিয়নে। এই কর্মসূচি আরও বিস্তৃত করা সম্ভব কি না, অনুষ্ঠানে তা নিয়ে আলোচনা হয়। পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ও অনুষ্ঠানের সভাপতি কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, এই কর্মসূচি সম্প্রসারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। অর্থায়নও কম আসছে।