‘ছায়াবন্দনায়’ ক্যামেরা–কবি নাসির আলী মামুন
‘ক্যামেরার কবি’ হিসেবে সমাদৃত হয়েছেন আলোকচিত্র শিল্পী নাসির আলী মামুন। পাঁচ দশক ধরে দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা, কৃতী মানুষদের প্রতিকৃতি আলোকচিত্রে ধারণ করে চলেছেন। প্রতিকৃতি চিত্রে একটি নিজস্ব ধারা সৃষ্টি করেছেন তিনি। সে কারণেই তাঁর এই বিশেষ সমাদর।
এত দিন নাসির আলী মামুন দেখিয়েছেন কৃতী মানুষের মুখ। এবার তিনি দর্শকদের সামনে এলেন অন্যভাবে। তাঁকে নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে, ‘ছায়াবন্দনা’ (নাসির আলী মামুন: ইন প্রেইজ অব শ্যাডোজ)। আজ শুক্রবার বিকেলে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হলো তথ্যচিত্রটির প্রিমিয়ার প্রদর্শনী।
যুক্তরাজ্যপ্রবাসী নির্মাতা মকবুল চৌধুরী এক ঘণ্টার এই তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কোলাকার প্রোডাকশন এর প্রযোজনা করেছে। তথ্যচিত্রের সংগীত পরিচালনা করেছেন ব্রিটিশ সংগীত পরিচালক জ্যাক ব্লুর।
নাসির আলী মামুনের জন্ম পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারে, ১৯৫৩ সালের পয়লা জানুয়ারি। ঢাকাতেই বেড়ে ওঠা। শৈশব থেকেই আলোকচিত্রের প্রতি তাঁর অনুরাগ। প্রতিকৃতি ধারণ শুরু করেছিলেন ১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি তোলার মধ্য দিয়ে। এরপর তিনি গত পাঁচ দশকে দেশের সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি, রাজনৈতিক জগতের প্রায় সব কৃতী মানুষদের আলোকচিত্র গ্রহণ করেছেন। শুধু দেশেই নয়, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও কৃতী মানুষের মুখ খুঁজে নিয়েছে তাঁর ক্যামেরার লেন্স। অ্যালেন গিন্সবার্গ, গুন্টার গ্রাস, মাদার তেরেসা, মিখাইল গর্বাচেভ থেকে শুরু করে অমর্ত্য সেনসহ অনেকের মুখচ্ছবি ধারণ করেছেন তিনি। প্রায় আট হাজার মানুষের লক্ষাধিক ছবি তুলেছেন নাসির আলী মামুন। তাঁর তোলা এসব সাদা-কালো ছবি এক নান্দনিক সুষমা সৃষ্টির পাশাপাশি ছবির মানুষটির ব্যক্তিত্বকেও ফুটিয়ে তোলে। দেশ-বিদেশে তাঁর ছবির অর্ধশতাধিক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। পেয়েছেন শিল্পকলা পদক, ডেইলি স্টার আজীবন সম্মাননা, বাংলা একাডেমি সাম্মানিক ফেলোশিপ।
তথ্যচিত্রে নাসির আলী মামুনের জীবন-কাহিনি তুলে ধরার পাশাপাশি তাঁর তোলা বিখ্যাত মানুষদের প্রতিকৃতি, তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক, ছবি তোলার নেপথ্য কাহিনিও তুলে ধরা হয়েছে। মাঝে মাঝে মামুনের ছবির কারিগরি দিক, নান্দনিকতা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন বিশিষ্ট শিল্পী, আলোকচিত্রী, শিল্পসমালোচক, শিক্ষাবিদ ও সংস্কৃতিজনেরা। মোট ১২টি পর্বে ভাগ করে তাঁর জীবন ও কর্ম এই তথ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে।
তথ্যচিত্রটি প্রদর্শনীর আগে ছিল উদ্বোধনী সভা। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও সমাজচিন্তক বদরুদ্দীন উমর তথ্যচিত্রের উদ্বোধন করেন। তিনি বলেন, নাসির আলী মামুন তাঁর (বদরুদ্দীন উমর) ছবি তুলতে গিয়েছিলেন ১৯৮১ সালে। তখন মামুন ছিলেন সদ্য যুবক। নিরবচ্ছিন্নভাবে কৃতী মানুষের মুখচ্ছবি তুলে তিনি সমাজ-সংস্কৃতির ইতিহাসের উপাদান সৃষ্টি করেছেন। তবে দেশের পরিস্থিতি এখন সংকটময়। মানুষের দুর্দশার শেষ নেই। ৮০ শতাংশ মানুষ খারাপ অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। দেশ ও এসব দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের ছবি তোলার জন্যও তিনি মামুনের প্রতি আহ্বান জানান।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, মামুন দীর্ঘকাল ধরে যে কাজ করে চলেছেন, তা একেবারেই হৃদয়ের টানে। এর সঙ্গে কোনো আর্থিক লাভ-লোভের যোগ নেই। তাঁর ছবি বিক্রির জন্য নয়, যাঁরা ছবি তোলেন, তাঁর কাছ থেকেই মামুন কোনো আর্থিক সুবিধা পান না। মুনাফার রাজত্বময় এই সমাজে মামুনের এই কাজ এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
আলোচক চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম বলেন, মামুন যেমন ভালোবাসা থেকে প্রতিকৃতি তুলে যাচ্ছেন, তেমনি মকবুল চৌধুরীও মামুনের প্রতি ভালোবাসা থেকেই এই তথ্যচিত্রটি নির্মাণ করেছেন।
নির্মাতা মকবুল চৌধুরী বলেন, নাসির আলী মামুনের সঙ্গে ১৯৯৫ সালে তাঁর পরিচয় হয়েছিল লন্ডনে। তখন থেকেই তাঁকে নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে কাজ শুরু হয় গত পাঁচ বছর থেকে। মামুন একজন অক্লান্ত শিল্পী, যিনি কোনো আর্থিক সুবিধার কথা না ভেবে আলোকচিত্রের এই বিশেষ মাধ্যমটির চর্চা করে চলেছেন। শিল্পের প্রতি তাঁর এই সংগ্রামকে তুলে ধরতেই তথ্যচিত্রটি নির্মাণ করেছেন।
নাসির আলী মামুন তাঁর প্রতিক্রিয়ায় অনুষ্ঠানের অতিথি, চলচ্চিত্রটির নির্মাতা, কলাকুশলী এবং তিনি যাঁদের ছবি তুলেছেন, যাঁরা বিভিন্ন সময় সহায়তা, উৎসাহ দিয়েছেন এবং নিজের পরিবারের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, অনেক সংগ্রাম, আর্থিক সংকট, বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে তিনি তাঁর প্রিয় কাজটি করে যাচ্ছেন। এই বিপুল সংগ্রহ সংরক্ষণের জন্য ‘ফটোজিয়াম’ নামে একটি সংগ্রহশালা নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন। এ কাজে তিনি সবার সহযোগিতা কামনা করেন। একই সঙ্গে জানালেন, আগামী দিনগুলোতেও প্রতিকৃতি ধারণের কাজ চালিয়ে যাবেন তিনি।