‘গোপনে’ দ্বিতীয় বিয়ে, প্রথম স্ত্রীর তোপে ২২ দিন কাটাতে হলো মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রে

ফিরোজ আহমেদ
ছবি: সংগৃহীত

সুস্থ এক ব্যক্তিকে মাদকাসক্ত সাজিয়ে একটি মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রে ২২ দিন আটকে রাখা হয়। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের ভুল হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে ঢাকার উত্তরার রেইনবো মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে। এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এর আগেও এ ধরনের কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছিল।

ভুক্তভোগী ব্যক্তির নাম ফিরোজ আহমেদ। তিনি ঢাকার আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানার স্টোর ম্যানেজার। তাঁর পরিবারের অভিযোগ, ফিরোজের প্রথম স্ত্রী আকলিমা আক্তার ও তাঁর স্বজনেরা বোরহান দেওয়ান নামের এক ব্যক্তির যোগসাজশে ১৩ সেপ্টেম্বর তাঁকে রেইনবো মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি করেন।

গত ১২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকার সাভারে দ্বিতীয় স্ত্রীর বাসা থেকে বের হন ফিরোজ। এর পর থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন। স্বামীর খোঁজ না পেয়ে ১৯ দিন পর ১ অক্টোবর ফিরোজের দ্বিতীয় স্ত্রী নাজমা আক্তার সাভার থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।

ফিরোজের মা জান্নাতুল ফেরদৌস আজ মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ফিরোজের প্রথম স্ত্রী আকলিমা আক্তার থাকেন আশুলিয়ার জিরাবোতে। প্রথম স্ত্রীর সন্তান না হওয়ায় ১০ বছর আগে ফিরোজ দ্বিতীয় বিয়ে করেন। বিষয়টি নিয়ে কয়েক মাস ধরে প্রথম স্ত্রীর পরিবারের সদস্যরা নানাভাবে তাঁকে হয়রানি করছিলেন। এর আগেও ফিরোজকে আটকে রেখে সাড়ে আট লাখ টাকা আদায় করেছিলেন তাঁরা। বোরহান দেওয়ান নামের ওই ব্যক্তিও ফিরোজকে বিভিন্ন সময় ফোন করে নানা হুমকি দিতেন।

জান্নাতুল ফেরদৌস আরও বলেন, ফিরোজ নিখোঁজ হওয়ার পর আকলিমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কিছু জানেন না বলে দাবি করেন। বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজির পর আজ জানা যায়, ফিরোজকে উত্তরায় একটি মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রে আটকে রাখা হয়েছে। বোরহানের মাধ্যমে ফিরোজকে সেখানে ভর্তি করে আকলিমার পরিবার। এরপর ফিরোজের পরিবার বিষয়টি র‌্যাবকে জানায়। র‌্যাব যোগাযোগ করলে সন্ধ্যায় নিরাময়কেন্দ্র থেকে জানানো হয়, বোরহান নামের এক ব্যক্তি সন্ধ্যায় ফিরোজকে নিয়ে গেছেন।

র‌্যাবের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম স্ত্রীকে না জানিয়ে ১০ বছর আগে ফিরোজ নাজমা নামের এক নারীকে বিয়ে করেন। তবে বিষয়টি জানাজানি হয় চার মাস আগে। প্রথম স্ত্রীর পরিবার আশুলিয়ার জিরাবো এলাকায় বেশ প্রভাবশালী। তারাই ফিরোজকে মাদকাসক্ত সাজিয়ে মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রে ভর্তি করায়।

ফিরোজের প্রথম স্ত্রী আকলিমার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে আজ বিকেলে তিনি দাবি করেন, ফিরোজ কোথায় আছেন তিনি জানেন না। রেইনবোর ভর্তি নিবন্ধন খাতায় তাঁর মুঠোফোন নম্বর দেওয়া কেন জানতে চাইলে আকলিমা বলেন, তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে জানাবেন।

সন্ধ্যার পর আকলিমার মুঠোফোনে আবার যোগাযোগ করা হয়। এ সময় ওই মুঠোফোনেই তাঁর ভাই মোজাম্মেল হকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের না জানিয়ে ফিরোজ দ্বিতীয় বিয়ে করেন। কয়েক দিন আগে বিষয়টি তাঁরা জানতে পারেন। এরপর ফিরোজ ও তাঁর আত্মীয়দের আলোচনার জন্য ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা আসেননি। সমস্যারও সমাধান হয়নি।

ফিরোজকে মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্র ভর্তি করা হয়েছে কেন, জানতে চাইলে মোজাম্মেল হক বলেন, ফিরোজ প্রথম স্ত্রীর (আকলিমা আক্তার) বাসায় বেশিক্ষণ থাকতেন না। মধ্যরাতে বাসা থেকে বের হয়ে যেতেন। এ নিয়ে তাঁদের সন্দেহ হয় যে ফিরোজ মাদকাসক্ত। তাঁকে সুস্থ মনে না হওয়ায় মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়।

রেইনবো মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রটি উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর সড়কে অবস্থিত। এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ এবারই প্রথম নয়, এর আগে ২০১৯ সালে জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে এক ব্যক্তিকে আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছিল প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।

ফিরোজের বিষয়ে জানতে রেইনবো মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রের পরিচালক এফ এম কাউসারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ফিরোজকে তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা নিরাময়কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। তাঁরা খুবই জোর দিয়ে বলেছিলেন, ফিরোজ মাদকাসক্ত। তাঁর স্ত্রী (প্রথম) বলেছিলেন, ফিরোজ মাদক সেবন করে তাঁকে মারধর করতেন। ডোপ টেস্টেও তিনি ‘পজিটিভ’ হয়েছিলেন। এ কারণে ফিরোজকে মাদকাসক্ত হিসেবে ভর্তি করা হয়। তবে বিষয়টি ভুল হয়ে গেছে। তাঁর (ফিরোজের) পূর্বের ইতিহাস জেনে তাঁকে এখানে ভর্তি করা উচিত ছিল। ফিরোজকে আজ সন্ধ্যায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

ফিরোজের মা জান্নাতুল প্রথম আলোকে বলেন, ফিরোজের প্রথম স্ত্রী আকলিমার পরিবারের ঘনিষ্ঠ বোরহান দেওয়ান তাঁদের হয়রানি ও বিভিন্ন সময় তাঁদের কাছে অর্থ দাবি করতেন। তিনিই ফিরোজকে মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রে ভর্তি করেছিলেন।

বোরহান দেওয়ানের বিষয়ে রেইনবোর পরিচালক এফ এম কাউসার বলেন, তিনি (বোরহান) রেইনবো মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বোরহান দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি আশুলিয়া এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করেন। এই সূত্রে ফিরোজের প্রথম স্ত্রী আকলিমার পরিবারের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। আকলিমার পরিবার জানিয়েছিল, ফিরোজ মাদকাসক্ত। এ কারণে তাঁকে রেইনবো মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছিল। এখন ফিরোজকে তাঁর প্রথম স্ত্রী আকলিমার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আকলিমাও প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ফিরোজ এখন তাঁর কাছে আছেন।

ফিরোজকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে মা জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, তাঁর ছেলে কখনো মাদক সেবন করেননি। তাঁকে নির্মম নির্যাতন করা হচ্ছে। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পুলিশ ও র‌্যাবের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।

বিষয়টি জানানো হলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (ঢাকা উত্তর) মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, রেইনবো মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স নেওয়া একটি প্রতিষ্ঠান। যদি কোনো অনিয়ম করে থাকে, তাহলে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।