নতুন ভবনে ভাড়া তিন গুণ

ভবনটি উদ্বোধন করা হয়েছে গত আগস্টে। এখনো চালু হয়নি সব সুবিধা। বাড়তি ভাড়ার কারণে অনেকে পুরোনো ভবনে যেতে চাইছেন।

রাজধানীর নীলক্ষেতে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের নতুন ১০ তলা ভবন
ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর নীলক্ষেতে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের পুরোনো দুটি ভবনে এক কক্ষে চারজনের একটি আসনের ভাড়া মাসে ১ হাজার ১২০ টাকা। পুরোনো ভবনের পাশেই নতুন একটি ১০ তলা ভবন হয়েছে। সেটিতে এক কক্ষে চারজন থাকতে জনপ্রতি ভাড়া ৩ হাজার ৭৪৬ টাকা। অর্থাৎ নতুন ভবনে ভাড়া তিন গুণের বেশি।

নতুন ভবনে কক্ষ পুরোনোটির চেয়ে একটু বড়। বাড়তি সুবিধা হলো, এতে বিউটি পারলার, লন্ড্রি ও ব্যায়ামাগারের জায়গা রয়েছে। সমস্যা হলো, উদ্বোধনের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও এসব সুবিধা চালু হয়নি। কবে চালু হবে, তা-ও নিশ্চিত নয়। নতুন ভবনের বাসিন্দা কর্মজীবী নারীরা বলছেন, ভবনটিতে ঝাড়বাতি ও এলইডি বাতির নির্দেশকের মতো বিলাসিতা করা হয়েছে। কিন্তু যে সুবিধা খুবই জরুরি, সেই ক্যানটিন সুবিধা নেই। খেতে হয় পুরোনো ভবনে গিয়েই। নারীদের জরুরি পণ্য বিক্রির দোকানও নেই।

হোস্টেলের প্রবেশপথ
ছবি: সংগৃহীত

সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এই দাঁড়িয়েছে যে সাধারণ কর্মজীবী নারীদের অনেকে নতুন ভবনের আসন ছেড়ে দিয়ে পুরোনো ভবনে যাওয়ার আবেদন করেছেন। জানতে চাইলে বিষয়টি স্বীকার করেন সম্প্রতি যোগ দেওয়া হোস্টেল সুপার ছামিনা হাফিজ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নতুন ভবনের নির্ধারিত ভাড়া দিতে কারও কারও কষ্ট হচ্ছে। তাঁরাই পুরোনো ভবনে যাওয়ার আবেদন করছেন।

নতুন ভবনে ভাড়া এত বেশি কেন জানতে চাইলে ছামিনা হাফিজ বলেন, তাঁর জানামতে গণপূর্ত অধিদপ্তর কক্ষের আয়তন ও এলাকা বিবেচনায় যে ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেটাই পরে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তিনি মনে করেন, এক কক্ষে চারজন থাকার ক্ষেত্রে জনপ্রতি যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি বেশি। তবে এক কক্ষে একজনের জন্য নির্ধারিত ভাড়া ঠিকই আছে।

নীলক্ষেতে কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের নতুন ভবনে এক কক্ষে চারজন থাকার সুবিধা ছাড়াও চার শ্রেণির আসন রয়েছে: ১. শৌচাগার সুবিধাসহ একটি কক্ষে একজন থাকতে চাইলে ভাড়া ৬ হাজার ৬০৩ টাকা। পুরোনো ভবনে এই ভাড়া ২ হাজার ৫৬০ টাকা। সেখানে অবশ্য কক্ষের সঙ্গে সংযুক্ত শৌচাগার নেই। ২. নতুন ভবনে এক কক্ষে দুই আসনে (কমন বাথরুম) জনপ্রতি ভাড়া ৪ হাজার ১১০ টাকা। পুরোনো ভবনে এই ভাড়া ১ হাজার ৭৬০ টাকা। ৩. নতুন ভবনে এক কক্ষে দুই আসনে (বাথরুমসহ) জনপ্রতি ভাড়া ৩ হাজার ১৬৬ টাকা। পুরোনো ভবনে এমন আসন নেই। ৪. এক কক্ষে তিন আসনে জনপ্রতি ভাড়া ৩ হাজার ৬০৭ টাকা। পুরোনো ভবনে এই ভাড়া ১ হাজার ২৮০ টাকা।

কক্ষ ভাড়ার সঙ্গে ভর্তি ফি রয়েছে ৩ হাজার ২০০ টাকা। আর আবেদন ফরমের দাম ২০০ টাকা। এটা নতুন ও পুরোনো ভবনের ক্ষেত্রে সমান।

দেশে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর পরিচালিত ৯টি কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় নীলক্ষেতেরটি ছাড়া মিরপুর ও খিলগাঁওয়ে দুটি হোস্টেল রয়েছে। কোথাও নীলক্ষেতের নতুন ভবনের মতো এত বেশি ভাড়া নির্ধারণ করা হয়নি।

ব্যায়ামাগারের জন্য বরাদ্দ কক্ষটি এভাবেই ব্যবহার করা হয়
ছবি: মানসুরা হোসাইন

নীলক্ষেতের কর্মজীবী হোস্টেলের নতুন ভবনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, বাসাবাড়িতে যে ভাড়া নেওয়া হয়, তার চেয়ে বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে। নীলক্ষেত এলাকায় তিন কক্ষের একটি বাসার ভাড়া ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। প্রতি কক্ষে চারজন করে থাকলে ভাড়া দাঁড়াবে আড়াই হাজার টাকার আশপাশে। বসার ঘর (ড্রয়িং রুম) ও খাবার ঘরে (ডাইনিং রুম) আরও নিবাসী রাখা যাবে। এতে ব্যয় আরও কমবে।

ওই নারী হিসাব দেন যে হোস্টেলে একটি কক্ষে একা থাকতে বাইরে খাবার ব্যয়সহ তাঁর খরচ হয় মাসে ১৫ হাজার টাকার মতো। বাইরেই খেতে হয়, কারণ হোস্টেলের ক্যানটিনের খাবার মুখে তোলার মতো নয়। বাড়তি ব্যয়ে কর্মজীবী হোস্টেলে কেন থাকছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিরাপত্তা ও ভরসার জন্য। কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল সরকার পরিচালনা করে। তবে মহিলা অধিদপ্তর ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে সেবামূলক চিন্তা রাখেনি।

এই কক্ষটি বিউটি পারলারের জন্য বরাদ্দ
ছবি: মানসুরা হোসাইন

বাড়তি সুবিধা চালু হয়নি

নীলক্ষেত কর্মজীবী নতুন মহিলা হোস্টেল নির্মাণ এবং দেশের বিভিন্ন জেলায় বিদ্যমান কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের অধিকতর উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় নতুন ভবনটি তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৩৭ কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত আগস্টে ভার্চ্যুয়ালি ভবনটি উদ্বোধন করেন। নতুন ও পুরোনো ভবনের ৭৪৮টি আসনের মধ্যে খালি মাত্র ১৩টি, তা-ও নতুন ভবনে।

বাসিন্দারা নতুন ভবনের পরিচ্ছন্ন শৌচাগার, গরম পানির জন্য গিজার থাকা ও নিরাপত্তার জন্য ক্লোজড সার্কিট (সিসিটিভি) ক্যামেরা থাকায় সন্তুষ্ট। তবে আরও কিছু সুবিধার কথা বলা হলেও তা চালু হয়নি। নতুন ভবনের জন্য জনবল নিয়োগ হয়নি।

সম্প্রতি গিয়ে দেখা গেল, ব্যায়ামাগারের (জিম) ভেতরে কোনো সরঞ্জাম নেই। সেখানে টেবিল-চেয়ার বসিয়ে পড়াশোনা করছেন নারীরা। বিউটি পারলারের জন্য বরাদ্দ করা কক্ষে দুটি খালি খাট ফেলে রাখা হয়েছে। পাঠাগার তালাবদ্ধ। সেখানে কোনো বই নেই বলেও জানা গেছে। লন্ড্রিও চালু হয়নি। খেলাধুলার সুযোগ রাখার কথা বলা হলেও তা নেই। সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট সুবিধাও দেওয়া হচ্ছে না।

সূত্র জানিয়েছে, ব্যায়ামের সরঞ্জাম, লন্ড্রির আসবাব ও অন্যান্য উপকরণ এবং বিউটি পারলারের উপকরণ কেনার জন্য প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল না। এখন নতুন করে কিনতে উদ্যোগ নিতে হবে। অতিথি কক্ষের জন্য আসবাবও কেনা হয়নি।

এই ভবন নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক ও মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক সৈয়দা রোকেয়া জেসমিন প্রথম আলোকে বলেন, কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়ে বাকি কাজগুলো করবে।

খাবার না খেলেও ৪০০ টাকা

নীলক্ষেতের কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের বাসিন্দারা জানান, ক্যানটিনে মাসের শুরুতেই ৪০০ টাকা জমা দিতে হয়। এরপর কেউ যদি এক বেলা না খান, তবু টাকা ফেরত পাওয়া যায় না। ক্যানটিনের খাবারের মান খুব খারাপ। এ কারণে বেশির ভাগ বাসিন্দা বাইরের রেস্তোরাঁর খাবার খান। অনেকে নিজের কক্ষে হিটারে রান্না করেন। তবে ধরা পড়লে ৬০০ টাকা জরিমানা দিতে হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক বাসিন্দা প্রথম আলোকে জানান, হোস্টেলের পানির ট্যাংক নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। এ কারণে বাইরে থেকে পানি কিনে পান করতে হয়।