মা–বাবা হাসপাতালে, ছেলে ওএমএসের লাইনে

আজিমপুর ছাপরা মসজিদ এলাকায় ওএমএসের চাল ও আটা কিনতে মানুষের ভিড়ছবি: প্রথম আলো

একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন গাড়ি (প্রাইভেট কার) চালাতেন আরিফ মোল্লা। গেল ঈদুল আজহার এক দিন আগে মালিকের কেনা ছাগলের জন্য কাঁঠালপাতা পাড়তে গাছে উঠেছিলেন তিনি। তখন হঠাৎ গাছ থেকে পড়ে গিয়ে কোমরে মারাত্মক ব্যথা পান। চিকিৎসকেরা জানান, তাঁর কোমরের হাড় ভেঙে গেছে। অস্ত্রোপচার করাতে হবে। এর পর থেকে প্রায় দুই মাস ধরে বিছানায় আছেন তিনি।

আরিফের স্ত্রী রানী খাতুন। তিনি গৃহকর্মীর কাজ করেন। দুটি বাসায় ঘর মোছা, কাপড়চোপড় ও থালাবাসন ধোয়ার কাজ করে পান মাত্র আড়াই হাজার টাকা, যা দিয়ে বাসাভাড়াও হয় না। কারণ, আজিমপুরের চৌধুরীবাজার এলাকায় যে বাসায় তাঁরা থাকেন, এর ভাড়া চার হাজার টাকা।

আরিফ ও রানী দম্পতির বড় ছেলে সিয়াম মোল্লা। সে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। আজ বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টায় সিয়ামের সঙ্গে কথা হয় আজিমপুর ছাপরা মসজিদ এলাকায়। সেখানে খাদ্য অধিদপ্তরের খোলাবাজারে বিক্রির (ওএমএস) ট্রাক সেল থেকে চাল ও আটা কিনতে গিয়েছিল সে।

প্রচণ্ড ভিড় আর গরমের মধ্যে ১২ বছরের কিশোর সিয়াম যখন চাল ও আটা কেনার লাইনে দাঁড়িয়ে, তখন তার মা রানী খাতুন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কারণ, স্বামী (সিয়ামের বাবা) আরিফের আজ কোমরের অস্ত্রোপচার হওয়ার কথা।
আজ সকাল ৮টা থেকে দাঁড়িয়ে দুপুর ১২টায় পণ্য কেনার সুযোগ পায় সিয়াম। তবে ভিড় আর তাড়াহুড়ার মধ্যে বিক্রেতা সিয়ামের কাছে শুধু চাল বিক্রি করে। আটা না দিয়েই তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে এক গণমাধ্যমকর্মীর কাছে এসে আটা কিনে দেওয়ার অনুরোধ জানায় সিয়াম। পরে তার জন্য দুই কেজির এক প্যাকেট আটা কিনে দেওয়া হয়।

আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে আজিমপুরের ছাপরা মসজিদ এলাকায় খাদ্য অধিদপ্তরের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় খোলাবাজারে ট্রাকে করে চাল ও আটা বিক্রি করা হয়। এতে প্রতি কেজি চাল ৩০ টাকা আর আটা এক প্যাকেট (২ কেজি) ৪৩ টাকায় বিক্রি করা হয়। একেকজন সর্বোচ্চ ৫ কেজি চাল কেনার সুযোগ পান। আর আটা কিনতে পারে এক প্যাকেট। এতে লাগে ১৯৩ টাকা।

সিয়াম বলছিল, ‘বাসায় রান্নার চাল নেই। মা আমাকে এখানে চাল আর আটা কিনতে পাঠিয়েছে। আর বাবাকে নিয়ে মা গেছে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে।’

ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হয়েছে জানিয়ে সিয়াম বলে, ‘ভিড় আর ঠেলাঠেলির কারণে আব্বার ভোটার আইডির ফটোকপি একবার ছিঁড়ে গিয়েছিল। পরে ওকে (প্রতিবেশী বন্ধু লাবিনকে দেখিয়ে) লাইনে রেখে আমি আবার বাসায় দৌড়ে যাই। আবার আরেকটি ফটোকপি নিয়ে আসি। আপনারা আমার আব্বার জন্য দোয়া করবেন।’

সিয়ামের সঙ্গে তখন লাবিন নামের আরেকজন ছিল। সে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। তারা একে অপরের প্রতিবেশী। দুজনের হাতে ছিল ছোট বাজারের ব্যাগ। সেখানে চাল ও আটার প্যাকেট নিয়ে বাসার উদ্দেশে রওনা হয়েছিল তারা। সাত কেজি ওজনের পণ্যের ব্যাগ হাতে ধরে নিতে তাদের কষ্ট হবে দেখে আলেয়া বেগম নামের এক নারী ওই দুজনের ব্যাগ রশি দিয়ে বেঁধে দেন। ফলে ব্যাগটি হাতে নেওয়ার বদলে দুজন মাথায় নিয়ে বাসার দিকে রওনা হয়।

আলেয়া বেগম বলছিলেন, ‘সকাল তন তাগো লাইনে খাড়াইতে দেখছি। খুব কষ্ট লাগসে তাগো দেখে। তাগো ঘর দূরে। চাল ও আটার ব্যাগ হাতে ধরে ওই পথ যাইতে তাগো কষ্ট অইব। তাই রশি দিয়া বাইনধা দিলাম। এহন মাথাত কইরা লইতে পারব।’

পরে বেলা দুইটার সময় মুঠোফোনে কথা হয় সিয়ামের মা রানী খাতুনের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে জানান, অ্যাম্বুলেন্সে করে স্বামীকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাই ছেলেকে চাল কিনতে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, আজকে অস্ত্রোপচার করা হবে না। আগামী রোববার আবার হাসপাতালে নিতে বলা হয়েছে।

রানী খাতুন বলেন, ‘সে (স্বামী আরিফ) দুই মাস ধরে বিছানাতেই পড়ে আছে। কোনো কিছু নিজে করতে পারে না। অসুস্থ বলে তো ফেলে রাখতে পারি না। চেষ্টা করে দেখছি, যদি অস্ত্রোপচার করলে ভালো হয়। আরিফের কোমরের অস্ত্রোপচার করতে প্রায় ৫০ হাজার টাকা লাগবে।’ ভাইদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাসাভাড়া, সংসারের খরচ আর স্বামীর চিকিৎসার খরচ চালাচ্ছেন বলে জানান তিনি।