পরিবার–পরিজন ছাড়া যাঁদের ঈদ কাটে
ঈদের দিন বেলা তিনটা পর্যন্ত এক মা স্বাভাবিক প্রসবে যমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। আরেক মায়েরও স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে। লেবার রুমে তিন মায়ের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় প্রসবের চেষ্টা চলছে। তিনজন মায়ের অস্ত্রোপচার লাগবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রী ও প্রসূতিরোগ বিভাগের ইউনিট-৬-এর আজ বৃহস্পতিবার চিত্র এটি। এমন পরিস্থিতিতে পবিত্র ঈদুল আজহার দিনেও ইউনিটের ১২ জন চিকিৎসক, নার্স ও অন্য কর্মীদেরও ব্যস্ত দিন পার করতে হয়েছে।
স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের পাশাপাশি সাংবাদিক, পুলিশ, কেয়ারগিভারসহ বিভিন্ন পেশার কর্মীদের ঈদের দিন দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। ঈদে দায়িত্ব পালন করা বিভিন্ন পেশার কর্মীরা বলছেন, কাজ করতে গিয়ে মন খারাপ হয়। তবে তাঁরা এটিকে পেশাগত দায়িত্ব হিসেবে নেন বলে মন খারাপের মাত্রাটা খানিকটা কম থাকে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রী ও প্রসূতিরোগ বিভাগের ইউনিট-৬-এর চিকিৎসা কর্মকর্তা (ইনডোর) নুরুন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, ইউনিটে আজ রোগী ভর্তির তারিখ ছিল। তাই ঈদের ছুটি নেওয়ার কোনো উপায় ছিল না। জানালেন, তাঁর স্বামীও চিকিৎসক। তিনি ছুটি পেয়েছেন, তাই ১১ ও ৭ বছর বয়সী দুই মেয়েকে নিয়ে চট্টগ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে গেছেন। আর আজিমপুরে গৃহকর্মীর কাছে তিন বছর বয়সী মেয়েকে রেখে হাসপাতালে এসেছেন তিনি।
নুরুন নাহার বললেন, কর্মজীবী মায়ের সন্তানেরা বিষয়গুলো মেনে নেয় বা বুঝতে পারে। তাই মন খারাপ হলেও ঈদের দিন মায়ের কাজ করা নিয়ে আপত্তি করে না। তিনি জানান, সকাল আটটা থেকে কাজ শুরু হয়েছে, তাঁর বাড়ি ফিরতে রাত নয়টা পার হয়ে যাবে।
মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জমির মো. হাসিবুস সাত্তারের বাড়ি কক্সবাজারে। ঈদে ছুটি নেই। তাই তিনি, তাঁর স্ত্রী ও চার বছর বয়সী মেয়ের বাড়িতে যাওয়া হয়নি। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আত্মীয়স্বজন ছাড়া ঈদ করতে হচ্ছে বলে স্ত্রী ও মেয়ের মন খারাপ।
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলার বিশেষ প্রতিনিধি মাহবুব কবির চপল। তিনি পবিত্র ঈদুল ফিতরে ছুটি কাটিয়েছেন, তাই এই ঈদে ছুটি পাননি। বাবা মারা গেছেন অনেক আগে। নওগাঁর বাড়িতে থাকেন ৬৫ বছর বয়সী মা রেজিনা বেগম। ছেলে ছুটি পায়নি বলে তিনি চোখের পানি ফেলছেন।
মাহবুব বললেন, ‘ঈদে বাড়ি না গেলে মা খুব কষ্ট পান। আমার নিজেরও মন খারাপ থাকে। স্বজনদের সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়া, কোলাকুলি করা, ঢাকায় এসব কিছুই হয় না।’ তিনি জানালেন, আজ জাতীয় ঈদগাহে প্রধান ঈদের জামাতের অ্যাসাইনমেন্ট ছিল। সেখানে ঈদের নামাজটা পড়েই কাজে লেগে পড়ি।’
রাজধানীতে প্রবীণ বা অসুস্থ ব্যক্তিদের দেখভালের জন্য কেয়ারগিভার পেশা গুরুত্বপূর্ণ পেশায় পরিণত হয়েছে। কেয়ারগিভার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আসমা বেগমের সঙ্গে কথা হয় আগারগাঁওয়ের প্রবীণ হিতৈষী সংঘে। তিনি সেখানে থাকা একজন প্রবীণের দেখভালের দায়িত্ব পেয়েছেন। জানালেন, কাজের শর্তই ছিল ঈদে ছুটি নেওয়া যাবে না। তাঁর স্বামী থাকেন দেশের বাইরে। আট বছর বয়সী ছেলে কুমিল্লায় স্বজনদের কাছে।
ঈদে রাজধানী বেশ ফাঁকা থাকে। কিন্তু পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সদস্যদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাঁদের একজন সার্জেন্ট বাকি বিল্লাহ। আজ বেলা আড়াইটা থেকে বিজয় সরণিতে দায়িত্ব পালন করছেন।
বাকি বিল্লাহর বাবা ও মা থাকেন পাবনায়। ঈদ করার জন্য স্ত্রী আর দুই ছেলেকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাকি বিল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন-চারটা ঈদে ডিউটি করার পর কোনো এক ঈদে ছুটি মেলে। এ ছাড়া পরিবার-পরিজন ছাড়া একা একাই ঈদ করতে হয়। এতে মন খারাপ হয়। পরিবারের সদস্যদেরও মন খারাপ হয়। কিন্তু কিছু তো করার নেই, এটাই আমাদের কাজ।’
বাসায় একা, তাই বিশেষ কোনো খাবারের ব্যবস্থা ছিল না। ঘরে যা ছিল তা খেয়েই বাকি বিল্লাহ কাজে এসেছেন। তবে দুপুরে কর্তৃপক্ষের দেওয়া পোলাও, গরু ও মুরগির মাংস ও মিষ্টি খেয়েছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের দিন আড়াই থেকে তিন হাজার ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করছেন।
ঈদুল আজহায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী, কসাইসহ বিভিন্ন পেশার কর্মীদেরও পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদ করার ফুসরত মেলে না। ছুটি পান না বিভিন্ন বাসায় খণ্ডকালীন গৃহকর্মী হিসেবে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদেরও।
রাজিয়া বেগম মোহাম্মদপুরের কয়েকটি বাসায় খণ্ডকালীন গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন। ঈদের দিন সকালে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তাঁকে কাজে যেতে হয়েছে। বললেন, স্বামী কাজকর্ম করতে চান না। এক মেয়ে আর জামাতা বেড়াতে এসেছে। যে বাসায় কাজ করেন সেখান থেকে কোরবানির মাংস নিয়ে বাড়ি ফিরে রান্না করে সবাইকে খাওয়াবেন।
ঈদের দিনে কর্মব্যস্ত থাকতে হয় সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকদেরও। চালক নুরুল হক জানালেন, ভোরে বাড়ি থেকে কিছু না খেয়েই বের হয়েছিলেন, পরে হোটেলে খেয়েছেন। তাই ঈদ বলে আলাদা কিছু মনে হচ্ছে না। ‘গরিব মানুষের আবার ঈদ কিসের?’ অনেকটা আক্ষেপ করেই বললেন তিনি।