জন্মেছে ৩ ব্যাঘ্রশাবক, ৪ মাস গোপন রেখেছে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ

ফাইল ছবি

রাজধানীর মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানায় বাঘ দম্পতি শিউলি–কদম তিনটি শাবকের জন্ম দিয়েছে। এই তিন ব্যাঘ্রশাবকের জন্ম হয় গত ১৮ এপ্রিল। তবে এত দিন এ তথ্য গোপন ছিল। চার মাস পর আজ সোমবার প্রথম আলো ব্যাঘ্রশাবকের জন্মের এ তথ্য জানতে পারে।

চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, জন্মের পর প্রথম আট মাসে ব্যাঘ্রশাবকের মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে। তাই বিপৎকাল অতিক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত ব্যাঘ্রশাবকের জন্মের খবর জানাতে চায়নি তারা। তবে এক বাঘবিশেষজ্ঞ বলেন, ব্যাঘ্রশাবকের সুরক্ষার সঙ্গে জন্মের খবরের কোনো সম্পর্ক নেই। ব্যাঘ্রশাবক মারা যাওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। সেসব বিষয় সমাধান না করে শাবক জন্মের খবর গোপন করে কোনো লাভ হবে না।

ব্যাঘ্রশাবকের জন্মের খবর কেন গোপন রাখা হলো, জানতে চাইলে জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার আজ প্রথম আলোকে বলেন, এটা একটু গোপন রাখতে হয়েছে এ জন্য যে আগে বাচ্চার ছবি তোলার জন্য একটা সুযোগ দেওয়া হতো; একসময় খাঁচায় রাখা হতো, পরে বাচ্চাগুলো বাঁচানো যায়নি। এবার তারা চাইছেন, শাবকগুলো নিরাপদকালে পৌঁছাক।

এর আগে জাতীয় চিড়িয়াখানায় যেসব ব্যাঘ্রশাবক মারা গেছে, সেগুলো আট মাসের মধ্যে মারা গেছে। তাই এই আট মাসকে ‘অনিরাপদকাল’ বলে মনে করেন পরিচালক রফিকুল ইসলাম।

তথ্য গোপন যখন থেকে

২০১৬ সালে জাতীয় চিড়িয়াখানায় ‘টোকিও’ ও ‘মৈত্রী’ নামে দুটি ব্যাঘ্রশাবকের জন্ম হয়। জন্মের কয়েক মাস পর শাবক দুটি মারা যায়। তারপর ২০২১ সালে করোনার মধ্যে বাঘ দম্পতি টগর–বেলির ঘরে আরও দুটি বাচ্চার জন্ম হয়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম ঘটা করে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শাবক দুটির নাম রাখেন ‘দুর্জয়’ ও ‘অবন্তিকা’। তার কয়েক মাস পর শাবক দুটি মারা যায়।

এসব ঘটনার পর থেকে জাতীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের ভেতর ব্যাঘ্রশাবকের তথ্য গোপন রাখার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এর আগেও ব্যাঘ্রশাবক জন্মের তথ্য গোপন রেখেছিল মিরপুরের এই চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ।

গত বছর ৫ এপ্রিল টগর-বেলি তিনটি শাবকের (জুঁই, জবা ও রঙ্গন) জন্ম দিয়েছিল। তার মধ্যে রঙ্গন জন্মের পর থেকে দাঁড়াতে পারত না। রঙ্গনের তথ্য গোপন রেখে জুঁই ও জবার জন্মের তথ্য জানিয়েছিল চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠলে কয়েক মাস পর রঙ্গনের জন্মের তথ্য নিশ্চিত করে তারা। এবার চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ শিউলি–কদমের তিনটি শাবকের জন্মের তথ্য চার মাস গোপন রাখল।

শিউলি-কদম এর আগে আরও দুটি বাচ্চার জন্ম দিয়েছিল। সেগুলো বড় হয়েছে এবং চিড়িয়াখানায় প্রদর্শিত হচ্ছে। এই তিনটি ব্যাঘ্রশাবকের জন্মের পর চিড়িয়াখানায় এখন বাঘের সংখ্যা ১৪।

ব্যাঘ্রশাবকের মৃত্যুর যে কারণ বললেন বিশেষজ্ঞ

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জাতীয় চিড়িয়াখানায় যেসব ব্যাঘ্রশাবক মারা গেছে, তার পেছনে মাছিবাহিত রোগের কথা উঠে এসেছিল। এর বাইরেও কিছু কারণের কথা বলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম এ আজিজ, যিনি যুক্তরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঘ নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন।

এম এ আজিজ বলেন, শারীরিক পরিশ্রম করলে মানুষ অসুস্থ কম হয়। একইভাবে যেসব প্রাণীর জঙ্গলে থাকার কথা, শিকার করে খাওয়ার কথা, সেটা না করে তাদের ছোট বন্দিশালায় রাখা হলে তাদের শারীরিক পরিশ্রম কম হয়। সে জন্য বন্য প্রাণীর চেয়ে খাঁচার প্রাণীর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকে।

চিড়িয়াখানায় প্রজননের জন্য স্ত্রী ও পুরুষ বাঘ আনা হলে সেগুলোর ইতিহাস জেনে আনা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন এই বাঘবিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, একই খাঁচায় রাখা নারী–পুরুষ বাঘ দুটি যেন জিনগত বৈচিত্র্যের অধিকারী হয় বা ভাই–বোনের মতো কাছাকাছি রক্তের সম্পর্কের না হয়। কাছাকাছি সম্পর্কের হলে তাদের মধ্যে জিনগতভাবে কিছু সমস্যা তৈরি হয়। কিছু জিন আছে, কাছাকাছি সম্পর্কের হলে সেগুলো প্রকাশিত হয়, তখন বাচ্চাগুলো মারা যায়।

বহু দিন ধরেই চিড়িয়াখানার আধুনিকায়নের কথা শোনা গেলেও বাস্তবে তা দেখা যাচ্ছে না উল্লেখ করে এম এ আজিজ বলেন, চিড়িয়াখানায় যেসব খাঁচা আছে, তা প্রজননের জন্য যথেষ্ট নয়। আরও বড় জায়গা হওয়া উচিত। সেখানে কিছু প্রাকৃতিক বনাঞ্চল থাকা উচিত, যাতে বাচ্চারা খেলতে ও শিখতে পারে। জায়গা না দেওয়া হলে ব্যাঘ্রশাবক মানসিকভাবে দুর্বল থাকায় শারীরিকভাবেও দুর্বল থাকে।

মানুষের কাছ থেকে আড়াল করতে গিয়ে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ নতুন জন্ম নেওয়া বাচ্চা তিনটিকে অল্প জায়গায় আটকে রাখলে সেগুলোর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হবে না বলে জানান এম এ আজিজ। আজ চিড়িয়াখানার বাঘের খাঁচাগুলো ঘুরে শাবক তিনটির দেখা পাওয়া যায়নি।