সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণে নারীদের ভূমিকা ভুলে গেলে চলবে না

শনিবার অনলাইনে আয়োজন করা হয় আলোচনাচক্র ‘পূর্ব বাংলার উত্থানপর্ব: পঞ্চাশ দশকের নারী জাগরণ’
ছবি: সংগৃহীত

সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণে বাংলার নারীদের সংগীত, নাচ ও নাটকের চর্চা ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। এসব ক্ষেত্রে নারী পথস্রষ্টাদের ভূমিকা ভুলে গেলে চলবে না। শনিবার অনলাইনে আয়োজন করা হয় আলোচনাচক্র ‘পূর্ব বাংলার উত্থানপর্ব: পঞ্চাশ দশকের নারী জাগরণ’। আলোচনায় ৫০ দশকের কিংবদন্তিতুল্য নারীদের স্মরণ করার মধ্য দিয়ে এদেশে নারী জাগরণের ইতিহাস তুলে ধরেন বক্তারা।

আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে ‘উত্তরসূরী: নূরজাহান-সারওয়ার মুরশিদ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফৌজিয়া মোসলেমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার স্টাডিজ ও গ্লোবাল স্টাডিজের শিক্ষক ইলোরা শেহাবুদ্দীন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মফিদুল হক এবং লেখক–গবেষক কাজী সুফিয়া আখতার।

আলোচনার শুরুতে আয়োজক সংস্থা উত্তরসূরির লক্ষ্য তুলে ধরেন সঞ্চালক ও উত্তরসূরির কর্ণধার শারমীন মুরশিদ। তিনি বলেন, ‘নতুন সমাজ গঠনে একটি সুস্থ সমাজ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে ৫০ ও ৬০ দশকের আলোকিত তরুণেরা যে ঐতিহ্য গড়ে তুলেছিলেন, নূরজাহান-সারওয়ার মুরশিদ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সেই ইতিহাস ধারণ করতে চায়। তাঁদের ভাবনাচিন্তা পুনরুদ্ধার করার মধ্য দিয়ে উত্তরসূরি মধ্যস্থতার কাজটি করবে।’

‘নূরজাহান ও তাঁর সময়’ বিষয়বস্তুর ওপর ইলোরা শেহাবুদ্দীন বলেন, ‘নূরজাহান মুরশিদের শেষ জীবনের লেখা থেকে জীবন ও রাজনীতিতে তাঁর সম্পৃক্ততার ইতিহাস জানা যায়।’ তিনি লিখেছেন, ‘নারী-পুরুষ একে অন্যের শত্রু নয়... নারী কোনো মাইনরিটি নয়। জনগোষ্ঠীর অর্ধেক হলো নারী, যাঁদের মুক্তি ছাড়া সমাজের মুক্তি সম্ভব নয়।’

মফিদুল হক তাঁর ‘নারী মুক্তির পথিকৃৎ’ বিষয়বস্তুর নিয়ে আলোচনায় বলেন, ‘কলকাতায় মুসলিম নারীদের শিক্ষার সূত্রে যে জাগরণের জন্ম, তারই পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম সমাজে শিক্ষিত, বহুত্ববাদী, উদার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে।

১৯৪৭-এর দেশ ভাগের পর এই নারীদের দ্বারাই পরিবর্তন সূচিত হয়। তাঁদের মধ্যেই সুফিয়া কামাল, নূরজাহান বেগ, পরবর্তীকালে নূরজাহান মুরশিদ তাঁদের দেখতে পাই।

নূরজাহান মুরশিদসহ সেলিনা বানু, দৌলতুন্নেসা খাতুন ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন। এটা নারীদের একটি বড় অর্জন ছিল। ভাষা আন্দোলনেও বিপুলসংখ্যক ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ছিল। পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণে নারীদের সংগীত, নাচ ও নাটকের চর্চা ভূমিকা রাখে। এসব ক্ষেত্রে নারী পথস্রষ্টাদের ভূমিকা ফিরে দেখতে হবে।’

কাজী সুফিয়া আখতার ‘আমার চোখে পঞ্চাশ দশক’ শিরোনামে আলোচনা পেশ করেন। তিনি ইতিহাস থেকে বাদ পড়ে যাওয়া অনেক নারীর স্বীকৃতির বিষয়টি নজরে আনার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলেন। তাঁর মতে, ‘৫২–এর ভাষা আন্দোলনের সময় ৪৪ ধারা যাঁরা ভঙ্গ করেছিলেন, সেসব নারী পুরস্কৃত হয়েছেন। কিন্তু বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষিকারা, যাঁরা তাঁদের ছাত্রীদের আন্দোলনে নিয়ে এসেছিলেন, তাঁরা ইতিহাসে স্থান পাননি। এমনকি ঢাকা থেকে দূরে থাকার কারণে অনেক নারী আড়ালে রয়ে গেছেন, যেমন দৌলতুন্নেসা কিংবা বাসন্তী গুহঠাকুরতা। এ ছাড়া নারীরা গান, চলচ্চিত্র ও নৃত্যকলার জগতে অবদান রেখেছে। রওশন জামিল যেমন নাচ ও অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে নারী আন্দোলনের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছেন।’

মূল বক্তব্য উপস্থাপনার পর আলোচনায় যোগ দেন দেশের বিশিষ্ট নারীবাদী ও গবেষক মালেকা বেগম, সোনিয়া নিশাত আমিন, নৃত্যশিল্পী ও গবেষক লুবনা মারিয়াম, আরমা দত্ত এবং তরুণ সমাজের প্রতিনিধি জেরিন তাসলিমা।

মালেকা বেগম বলেন, ‘আমরা যখন রাজনৈতিক পার্টির আওতায় দলীয়ভাবে সবকিছু দেখি, তাতে অনেকের অবদান বাদ পড়ে যায়। সার্বিকভাবে দেখে নারী আন্দোলনের নিরপেক্ষ ইতিহাস লেখা জরুরি।’

সভাপতির বক্তব্যে ফৌজিয়া মোসলেম বলেন, ‘নারী আন্দোলন যে সমাজ–রূপান্তরের আন্দোলন, এই সন্ধানটা আমাদের করতে হবে নিরপেক্ষ একটি অবস্থান থেকে। নারী আন্দোলনের বিভিন্ন স্তর আছে। শুরুতে ছিল আত্ম–অনুসন্ধানের কাল, পরবর্তী সময়ে নারীরা আত্মশক্তিকে চিহ্নিত করেছে। সৃজনশীলতার সূত্রেই তাঁদের কাজ করতে হয়েছে। আজকের নতুন সমাজে সৃজনশীলতা কেমন হবে, সে বিষয়ে কাজ করতে হবে। নারীদের বুঝে নিতে হবে তাঁদের পাওনা কী!’

৫০ ও ৬০ দশকের প্রজন্মের জীবনকর্ম সংরক্ষণ করা এবং নতুন প্রজন্মের কাছে সেসব চিন্তা ও আদর্শ দৃশ্যমান করে তুলতে কাজ করে যাচ্ছে সংস্থাটি। ‘উত্তরসূরী’র মাসব্যাপী অনুষ্ঠানমালার তৃতীয় পর্বের আয়োজন ছিল এটি।