ভবন ধসে পড়ে, হেলে পড়ে, নড়চড় নেই রাজউকের

রাজধানীতে ১৩ বছরে অন্তত ১৪টি ভবনধস ও হেলে পড়ার ঘটনায় মৃত্যু ৪০ জনের। 

হেলে পড়া ভবনটি এক্সকাভেটর দিয়ে ভাঙা হচ্ছে কামরাঙ্গীরচরে
ফাইল ফটো

রাজধানীর তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়িতে ২০১০ সালের জুন মাসে একটি পাঁচতলা ভবন ধসে পড়ে। এতে মৃত্যু হয় ২৫ জনের। পরে জানা যায়, জলাশয়ের নরম মাটির ওপর কোনো ধরনের পাইলিং ছাড়া ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে।

রাজধানীতে যেকোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে হলে আগে ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র নিতে হয়। তারপর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছ থেকে নির্মাণ অনুমোদন নিতে হয়। নির্মাণ শেষে বসবাস করার জন্য বসবাস সনদ বা অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নিতে হয়। এসব ছাড়া ভবন নির্মাণ হচ্ছে কি না, তা দেখাও রাজউকের দায়িত্ব।

রাজধানীর তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়িতে ভবনটি ধসে পড়ার পর রাজউক জানায়, ভবনটির অনুমোদন ছিল না। নির্মাণের ক্ষেত্রে মানা হয়নি ইমারত নির্মাণ বিধিমালা।

পরিকল্পনা ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ রাজউকের মূল দায়িত্ব। এই দুই ক্ষেত্রেই সংস্থাটি ব্যর্থ। নিয়মের ব্যত্যয় করে ভবন হচ্ছে, কিন্তু সেটি তদারকি হচ্ছে না। এর পেছনে দুর্নীতি বড় কারণ। রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটা অংশ লাভের গুড়ের আশায় জনগণের জীবনকে হুমকিতে ফেলছে।
আদিল মুহাম্মদ খান, নগর গবেষণা ও নীতি বিশ্লেষণী প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক

রাজধানীতে গত এক যুগে অন্তত ১৪টি ভবনধস ও হেলে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় অন্তত ৪০ জনের প্রাণহানি হয়, আহত হন শতাধিক ব্যক্তি। অধিকাংশ ভবনধস ও হেলে পড়ার ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভবনের অনুমতি ছিল না অথবা নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে।

ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে এ ধরনের ঘটনা নিয়মিত হলেও নিয়ম মানাতে রাজউকের কার্যকর পদক্ষেপ নেই। এমনকি রাজউকের আওতাধীন এলাকায় কত ভবন অনুমোদনহীন, তা-ও রাজউক জানে না। ঢাকায় ভবনের ঝুঁকি নিরূপণে জরিপ পরিচালনা ও তালিকা তৈরির দায়িত্বও সংস্থাটির। কিন্তু সেই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকাও তারা করেনি।

বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারে একটি ভবনে বিস্ফোরণে ২৪ জনের মৃত্যুর পর। এ ঘটনার পর পুলিশ ধারণার ভিত্তিতে বলেছে, ভবনটি পাঁচতলার অনুমোদন নিয়ে সাততলা বানানো হয়েছে। রাজউক এখনো ওই ভবনের মূল নকশাসহ অন্যান্য নথিপত্র খুঁজে পায়নি।

রাজধানীতে ভবনের ঝুঁকি নিয়ে জানতে চাইলে রাজউকের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, যেসব ভবন নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। বহু ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, রাজউকের আওতাধীন এলাকার ভবনগুলোর মধ্যে কতটি ভবনের বেজমেন্টকে বিপণিবিতান বা দোকান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা জানতে আটটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

পরিকল্পিত নগর গড়তে বড় শহরের একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকে। রাজউক তেমনই একটি সংস্থা। এর ওয়েবসাইটে জানানো হয়েছে। ১৯৫৬ সালে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার উন্নয়ন ও পরিবর্ধনের বিশেষ ক্ষমতা নিয়ে প্রথম ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি) প্রতিষ্ঠিত হয়।

এই সংস্থাই ১৯৮৭ সালে রাজউকে পরিণত হয়। ওই বছর রাজউকের পরিধি বিস্তৃত হয় ৫৯০ বর্গমাইল এলাকায়, যার আওতায় পড়েছে সাভার, কেরানীগঞ্জ ও অন্যান্য এলাকা। ১৯৫৯ সালে ডিআইটি প্রথম ঢাকার মহাপরিকল্পনা করে। ১৯৯৫ সালে ঢাকা মহানগর উন্নয়ন পরিকল্পনা করা হয়। ২০১০ সালে করা হয় বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ।

রাজউকের ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনের শুরুতেই বলা হয়েছে, সংস্থাটির রূপকল্প হলো, ‘স্বাস্থ্যকর ও বাসযোগ্য রাজধানী গড়ার প্রত্যয়ে গঠিত সর্বোচ্চ পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ’। তবে যুক্তরাজ্যের ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) ২০২২ সালের সূচকে বাসযোগ্যতার দিক দিয়ে ঢাকার অবস্থান দাঁড়িয়েছে ১৭২টি শহরের মধ্যে ১৬৬তম।

ধসে পড়া, হেলে পড়া ভবন

দেশে ভবন হেলে পড়া কিংবা ধসের ঘটনার হিসাব সরকারি কোনো সংস্থার কাছে নেই। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে ২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ঢাকায় অন্তত ১৪টি ভবন হেলে পড়া ও ধসের ঘটনার তথ্য পাওয়া যায়। যেমন ২০১৫ সালের ১৫ মে রামপুরা হাজীপাড়ার আদর্শ গলিতে ঝিলের পাড়ে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা একটি দোতলা বাড়ি ধসে পড়ে। এতে অন্তত ১২ জনের মৃত্যু ঘটে। বাড়িটির মালিক ছিলেন স্থানীয় যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামান চৌধুরী।

এ দুর্ঘটনার পর মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে রামপুরা থানায় মামলা হয়। তাঁকে গ্রেপ্তারও করে র‍্যাব। আদালত ও এলাকাবাসী সূত্র জানা যায়, কিছুদিন পরে মনির জামিনে বেরিয়ে আসেন। রামপুরার বাসিন্দা জুয়েল সওদাগর প্রথম আলোকে বলেন, ওই দুর্ঘটনায় দরিদ্র মানুষেরা মারা যান। তাঁরা কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। মামলার পেছনে লেগে থাকা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়।

২০১৫ সালে পুরান ঢাকার বংশালে ছয়তলা ভবন, একই বছর যাত্রাবাড়ীতে সাততলা ভবন, ২০১৬ সালে মোহাম্মদপুরে তাজমহল রোডে চারতলা ভবন, ২০১৮ সালে পুরান ঢাকার লালবাগে পাঁচতলা ভবন ও ২০১৯ সালে কামরাঙ্গীরচরে একটি পাঁচতলা ভবন হেলে পড়ার ঘটনায় কারও মৃত্যু হয়নি। তবে ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই সদরঘাটের পাটুয়াটুলীতে একটি তিনতলা ভবনের একাংশ ধসে পড়ে। এতে বাবা ও ছেলের মৃত্যু হয়।

কামরাঙ্গীরচরের দক্ষিণ রসুলপুর এলাকায় পাঁচতলা একটি ভবন হেলে পড়ে ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি। ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কেরানীগঞ্জের মধ্য চরাইল এলাকায় তিনতলা একটি ভবন ডোবার মধ্যে উল্টে পড়ে। পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে ‘এত টুকু বাসা’ নামের ছয়তলা একটি ভবন ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট হেলে পড়ে। পুরান ঢাকার নাজিরাবাজারে পাঁচতলা একটি ভবনের আংশিক হেলে পড়ে ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর।

রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) জরিপ অনুযায়ী, সংস্থাটির আওতাধীন এলাকায় (ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, সভার উপজেলা, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের আংশিক) প্রায় ২১ লাখ ৪৫ হাজার স্থাপনা আছে। এর মধ্যে কতটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন, সেই তালিকা নেই সংস্থাটির কাছে।

রাজউক নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন নগর গবেষণা ও নীতি বিশ্লেষণী প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ রাজউকের মূল দায়িত্ব। এই দুই ক্ষেত্রেই সংস্থাটি ব্যর্থ। নিয়মের ব্যত্যয় করে ভবন হচ্ছে, কিন্তু সেটি তদারকি হচ্ছে না। এর পেছনে দুর্নীতি বড় কারণ। রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটা অংশ লাভের গুড়ের আশায় জনগণের জীবনকে হুমকিতে ফেলছে।

মানুষ ঝুঁকিতে

ঢাকার সম্প্রসারণ ও ভবন সংখ্যা বাড়ার বিপরীতে তা তদারকির সক্ষমতা রাজউকের আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সংস্থাটির কর্মকর্তারা দাবি করছেন, প্রয়োজনের তুলনায় তাঁদের জনবল অনেক কম। কিন্তু এ অভিযোগও রয়েছে যে জনবল ও সক্ষমতার একটি বড় অংশ রাজউক প্লট তৈরি ও ফ্ল্যাট নির্মাণের পেছনে ব্যয় করে। তাদের কাজ হওয়া উচিত ছিল নিয়ন্ত্রণ। সেখানেই তারা পিছিয়ে আছে।

এদিকে ভবনমালিকেরা অবৈধ ও ত্রুটিবিচ্যুতি রেখে ভবন নির্মাণ করে ভাড়া দিচ্ছেন। নগরের ভাড়াটেরা উচ্চ ভাড়া দিয়ে থাকলেও জানতে পারছেন না ভবনটি অবৈধ কি না, কতটা মজবুত।

রাজধানীর পাইকপাড়া এলাকার একটি ১০ তলা ভবনে থাকেন আবদুস সাত্তার। পাঁচ বছর আগে ভবনটি নির্মিত হয়। আবদুস সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বেজমেন্ট ও গ্যারেজের কাজ অসমাপ্ত রেখে চলে গেছে। একসময় ভবনে তিতাসের অবৈধ লাইন ছিল। ভ্রাম্যমাণ আদালত সেই সংযোগ বন্ধ করেছেন। তিনি বলেন, ভবনটি আদৌ নকশা মেনে হয়েছে কি না, বন্ধ করা তিতাসের লাইন এখন ঝুঁকিপূর্ণ কি না, এসব তো একজন ভাড়াটের পক্ষে যাচাই করা সম্ভব নয়।