বর্ষায় চলাচলে বিপর্যয়ের শঙ্কা

বর্ষার আগে সড়কের সংস্কারকাজ শেষ না হলে চলাচলে বিপর্যয় দেখা দেওয়ার শঙ্কা বাসিন্দাদের।

রাজধানীর হাজি ক্যাম্পের পাশে উত্তরখান এলাকায় সড়ক সংস্কারের অংশ হিসেবে কেটে রাখা হয়েছে সড়ক। সেখানে পানি জমে থাকায় দুর্ভোগে পড়েছেন স্থানীয় মানুষ। গত রোববার দুপুরেছবি: খালেদ সরকার

যুদ্ধ করেই যেন পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছাতে হয় আদিরা জাবিনকে। এই যুদ্ধ বাসা থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত চার কিলোমিটার রাস্তায়। কোথাও আগাগোড়াই ভাঙা, কোথাও একেবারে ওপড়ানো। কাদা–ময়লা পানিতে ডুবে আছে কোনো কোনো অংশ। গাড়ি চলাচলের উপায় নেই। এই বেহাল রাস্তা আর সরু অলিগলি হয়ে আদিরাকে মোটরসাইকেলে কেন্দ্রে পৌঁছে দেন বাবা।

আদিরা রাজধানীর দক্ষিণখানের এমারত হোসেন আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। দক্ষিণখানের আইনুছবাগে আদিরাদের বাড়ি। তার পরীক্ষাকেন্দ্র পড়েছে উত্তরখানের জিয়াবাগ কারিগরি ও বাণিজ্যিক কলেজে। সকাল ১০টায় পরীক্ষা শুরু হয়। আদিরাকে কেন্দ্রে পৌঁছাতে তার বাবা মো. ফারুককে বাসা থেকে মোটরসাইকেলে বের হতে হয় দেড় ঘণ্টা আগে।

গত রোববার বাংলা দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা দিতে রওনার সময় আদিরা প্রথম আলোকে বলে, রাস্তা এত ভাঙাচোরা যে পরীক্ষাকেন্দ্রে যেতেই শরীর ব্যথা হয়ে যায়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, এমন দুর্ভোগের গল্প শুধু এক আদিরার নয়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার বিশাল জনগোষ্ঠীর। বিশেষ করে ঢাকা উত্তর সিটির সাতটি ওয়ার্ডের (৪৪, ৪৫, ৪৬, ৪৭, ৪৮, ৪৯ ও ৫০ নম্বর) বাসিন্দাদের।

এই ওয়ার্ডগুলো মূলত ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের একদিকে খিলক্ষেত থেকে শুরু হয়ে আরেক দিকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত রেললাইনের পূর্ব দিকে পড়েছে। এই সাত ওয়ার্ডের চারটি দক্ষিণখান আর তিনটি উত্তরখান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

বর্ষার আগে সড়কের সংস্কারকাজ শেষ না হলে চলাচলে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন এসব এলাকার বাসিন্দারা। ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আলী আকবর প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষ খুব কষ্ট করছেন, অস্বীকার করার উপায় নেই। কাজ যেহেতু শুরু হয়েছে, আশা করি মানুষের কষ্ট দ্রুতই লাঘব হবে।’

সাতটি ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মূলত দুটি কারণে সড়ক বেহাল। প্রথমটি হচ্ছে, আগে থেকে সেখানে পাকা সড়ক অবকাঠামো ও নর্দমার ব্যবস্থা না থাকা। যেগুলো ছিল, সংস্কার না করায় অধিকাংশ ভেঙে গেছে। দ্বিতীয়ত, বিকল্প পথ না করে মূল সড়ক কেটে উন্নয়নকাজ শুরু করা।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ওই এলাকার ড্রেনেজ–ব্যবস্থা এবং রাস্তা প্রশস্তকরণের জন্য মহাপরিকল্পনা নিয়েছি। রাস্তা ৭২ ফুট চওড়া হবে। সড়ক ও ড্রেনেজ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ সেনাবাহিনী শুরু করেছে। আগামী সপ্তাহে আমি দক্ষিণখানে যাব। বর্ষার আগে সড়কটিকে আগের চেয়ে ভালো অবস্থানে নেওয়ার চেষ্টা করছি।’

এই সাত ওয়ার্ডসহ ঢাকা উত্তর সিটিতে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত মোট ১৮টি ওয়ার্ডের সড়ক অবকাঠামো ও ড্রেনেজ নির্মাণ ও উন্নয়ন (ফেজ-১) প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে সরকার। ২০২২ সালের ৬ মার্চ প্রকল্পের উদ্বোধন হয়। এ প্রকল্পের আওতায় ১৮টি ওয়ার্ডে ৯০ দশমিক ৯৬৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ ও উন্নয়ন হবে। একই সঙ্গে ৯০ দশমিক ৯৬৬ কিলোমিটার নর্দমা নির্মাণ এবং ৬ দশমিক ৩৭৫ কিলোমিটার খাল উন্নয়ন করা হবে।

স্থানীয় সরকার বিভাগ ও ঢাকা উত্তর সিটি সূত্র জানিয়েছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার এ প্রকল্পে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করে। তবে অর্থবছরের আট মাস হতে চললেও প্রথম কিস্তিতে মাত্র ৮৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা ছাড় করেছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় কিস্তিতে ১৭৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা ছাড়ের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮০ কোটি টাকা ছাড় করা হয়। সব মিলে এ প্রকল্পে ১৬৭ কোটি ৫০ লাখ ছাড় হয়। ফলে অর্থসংকটে প্রকল্পের কাজ ঢিলেঢালা হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে।

চরম দুর্ভোগ

সরেজমিনে দেখা গেছে, দক্ষিণখানের প্রধান সড়ক কসাই বাজার রেলগেট-কাঁচকুড়া সড়কসহ ওই এলাকার সাতটি রাস্তা কাটা হয়েছে। সড়ক ও ড্রেনেজ নির্মাণের জন্য সেখানে ড্রেজার দিয়ে খনন করে কংক্রিটের পাইপ বসানোর পর কোথাও কোথাও খোয়া-বালু ফেলার কাজ চলছে। ফলে রাস্তায় গাড়ি চলাচল তো নয়ই, মানুষের হাঁটার পথও বন্ধ হয়ে পড়েছে। এতে বিমানবন্দর বা উত্তরার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়া স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীসহ লাখ লাখ বাসিন্দা অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মুখে পড়েছেন। রাস্তার কারণে এলাকার ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।

দক্ষিণখানের মজিদ কমপ্লেক্সে রিফাত স্যানিটারির স্বত্বাধিকারী আবদুল মালেক প্রতিদিন উত্তরা থেকে আসেন দোকানে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কসাই বাজার রেলগেট থেকে দক্ষিণখান পর্যন্ত দুই কিলোমিটার রাস্তা। এখন এই পথ তিন কিলোমিটার ঘুরে দুবার অটোরিকশায়, দুবার অটোরিকশা থেকে নেমে হেঁটে যেতে হয়। এত কষ্ট করে এসে দোকানভাড়াও ওঠে না।

রাজধানীর উত্তরখান এলাকার একটি সড়ক পয়োনালার পাইপ বসানোর জন্য কেটে রাখা হয়েছে। গত রোববার দুপুরে
প্রথম আলো

দেখা গেছে, কসাই বাজার রেলগেট-কাঁচকুড়া সড়কে যে পয়োনালার ব্যবস্থা ছিল, সেটি সড়ক ও ড্রেনেজ নির্মাণকাজের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে সড়কের দুই পাশে পাড়া-মহল্লার ড্রেনগুলো উপচে উঠছে। বাসিন্দারা বলছেন, বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে অন্তত দক্ষিণখানের মূল সড়কটি বালু-খোয়া ফেলে চলাচলের ব্যবস্থা করা না গেলে চরম বিপর্যয় নেমে আসবে।

যে ১৮টি নতুন ওয়ার্ডের সড়ক, পয়োনালা নির্মাণ ও উন্নয়নের কাজ চলছে, তার ১২টিই ঢাকা-১৮ সংসদীয় আসনের অধীন। এ আসনের সংসদ সদস্য পোশাক ব্যবসায়ী মো. খসরু চৌধুরী। তিনি ‘স্মার্ট ঢাকা’ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচন করেন। নির্বাচনী এলাকার মূল সমস্যা রাস্তাঘাট ও পয়োনিষ্কাশনের দুরবস্থা। তিনি নিজেও দক্ষিণখানে থাকেন।

খসরু চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি চেষ্টা করছি, আগামী মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে দক্ষিণখান সড়ক অন্তত ম্যাকাডাম পর্যায়ে (ঢালাইয়ের আগের স্তর) নিয়ে যাওয়ার। এর মধ্যে আমরা সুয়ারেজ লাইনটা চালু করে দেব, যাতে এলাকায় পানি না জমে। ইতিমধ্যে ছোট ছোট অনেক রাস্তায় ঢালাই শুরু হয়েছে।’