বেঁচে ফিরেছে বানরটি, তবে সন্তান হারিয়ে বিষণ্ন

একটি বড় খাঁচার মধ্যে বানরটিকে রাখা হয়েছে। সেখানকার কেয়ারগিভাররা বানরটির নাম দিয়েছেন ‘মনু’ছবি: মানসুরা হোসাইন

পাঁচতলা ভবনের ছাদে ঘুরে বেড়াত। হঠাৎ রাজধানীর গেন্ডারিয়ার ভবনটির ছাদ থেকে পড়ে গেল বানরটি। পেটের বাচ্চা বের হয়ে মারা গেল। গর্ভফুল অর্ধেক বের হয়ে ঝুলে ছিল। তবে চিকিৎসার পর এখন অনেকটাই সুস্থ, দ্রুতই নিজ ঠিকানায় ফিরবে বানরটি।

বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্তরা গত ২১ জুলাই গুরুতর আহত বানরটিকে উদ্ধার করেন। আগারগাঁওয়ে অধিদপ্তরের নির্দিষ্ট কক্ষে রেখে প্রাথমিক পরিচর্যা করা হয়। পরে প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন পিপল ফর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের (‘প’ ফাউন্ডেশন) প লাইফ কেয়ার ক্লিনিকের ভেটেরিনারি চিকিৎসকদের মাধ্যমে চিকিৎসা শুরু হয়। তবে অধিদপ্তরে রেখে বানরটির যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। পরে মিরপুরে প লাইফ কেয়ার ক্লিনিকে রেখেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার এ ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, একটি বড় খাঁচার মধ্যে বানরটিকে রাখা হয়েছে। সেখানকার কেয়ারগিভাররা বানরটির নাম দিয়েছেন ‘মনু’। পাকা আম, পেয়ারা আর বাদাম পছন্দের খাবার। কলা তেমন একটা পছন্দ না। প্রথম দিকে দুর্বলতার কারণে নিস্তেজ থাকলেও সুস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেজাজের মাত্রাটা দিনে দিনে বাড়ছে। খাঁচার কোন ফাঁক দিয়ে বের হওয়া যাবে, তা খুঁজে বের করার জন্য ব্যস্ত মনু। আকাশের দিকে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে।

প ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন স্থপতি রাকিবুল হক বললেন, পানি খেতে দিলে মাঝেমধ্যে পানি ফেলে দিয়ে ওই বাটি মাথায় দিয়ে বসে থাকে মনু। পুরান ঢাকায় পাড়া দাপিয়ে বেড়াত, এখানে খাঁচায় বন্দী থাকতে ভালো লাগছে না, তা বানরটির আচরণ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এ ছাড়া সন্তান মারা যাওয়ায় এমনিতেও বিষণ্ন থাকে। বন অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্তদের মাধ্যমে দ্রুতই বানরটিকে পুরান ঢাকায় নিজ ঠিকানায় ছেড়ে দেওয়া হবে।

গেন্ডারিয়ায় একটি ভবনের ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত বানরটি এখন অনেকটাই সুস্থ।

বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের বন্য প্রাণী পরিদর্শক অসীম মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, বানরটি ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ার পর ভবনের একজন বাসিন্দা বানরটিকে উদ্ধার করার জন্য ফোন দেন। সেদিন রাতেই উদ্ধার করে বন অধিদপ্তরে আনা হয়। বানরটির শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। এ ধরনের গুরুতর আহত বানরকে চিকিৎসা দেওয়ার মতো সক্ষমতা অধিদপ্তরের নেই। তাই বেসরকারি সংগঠন প ফাউন্ডেশনের সহায়তা নেওয়া হয়। দুই দিন অধিদপ্তরে বানরটিকে রাখা হলেও চিকিৎসা সেভাবে দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। সার্বক্ষণিক দেখভালের জন্য পরে বানরটিকে মিরপুরের ক্লিনিকে পাঠানো হয়।

গতকাল প ফাউন্ডেশনের প লাইফ কেয়ার ক্লিনিকের ভেটেরিনারি সার্জন আরিফা আক্তার ক্লিনিকের অস্ত্রোপচারকক্ষে নিয়ে বানরটিকে পরীক্ষা করে দেখেন। মনুর মেজাজ গরম থাকায় আরও দুজন মিলে ধরে রাখতে হচ্ছিল। মুখ দিয়ে অদ্ভুত ভাষায় রাগও দেখাচ্ছিল।

সব মিলে বানরটি এখন অনেকটাই সুস্থ। তবে ছেড়ে দেওয়ার আগে আলট্রাসাউন্ডসহ আরও কিছু পরীক্ষা করতে হবে
ছবি: মানসুরা হোসাইন

পরীক্ষা শেষে আরিফা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, বানরটির চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করা হয়। জরায়ু পরিষ্কার করা হয়। ভেতরে গর্ভফুলের আর কোনো অংশ আটকে আছে কি না, তা ভালোভাবে দেখা হয়। অধিদপ্তরে দুই দিন ছিল বানরটি, তখন বানরটির পেছন দিকে ঘা হয়ে তাতে মাছি ডিম পাড়া শুরু করেছিল। সেটারও চিকিৎসা দেওয়া হয়। সব মিলে বানরটি এখন অনেকটাই সুস্থ। তবে ছেড়ে দেওয়ার আগে আলট্রাসাউন্ডসহ আরও কিছু পরীক্ষা করতে হবে।

বানরটির শারীরিক অবস্থা খারাপ থাকায় বন অধিদপ্তর এবং প ফাউন্ডেশন কোনো ধরনের চিঠি চালাচালি না করে বা আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই চিকিৎসার উদ্যোগ নেয়। বন অধিদপ্তরের বেসরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে চিকিৎসাসেবা নিয়ে চুক্তি থাকলে কাজ করা আরও সহজ হবে বলে উল্লেখ করেন প ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা রাকিবুল হক।

চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বানরটিকে
ছবি: মানসুরা হোসাইন

প ফাউন্ডেশনের ছাদে একটি খাঁচায় দিন কাটছে মনুর। ফাউন্ডেশন উদ্ধার করা বিড়ালদের যেখানে রাখে, সেখানকার বেশ খানিকটা জায়গা দখল করে রেখেছে মনু। এতে অবশ্য বিড়ালগুলোও বেশ খানিকটা বিরক্ত।

পেটের সন্তান মারা গেছে, এই মানসিক ট্রমা কাটানোর জন্য কাপড় দিয়ে বানানো একটি বানর রাখা হয়েছিল খাঁচার মধ্যে। তবে মনু বা বানরটি সেটিকে কামড়ে ছিঁড়ে ফেলেছে বলে জানালেন কেয়ারগিভাররা। বানরটিকে খাবার দেওয়ার সময় কেয়ারগিভারদেরও বেশ খানিকটা সমঝে চলতে দেখা গেল। মা বানরের মনে যাতে কোনো আঘাত না লাগে।