আপনাদের ‘বাঙালি’ না বলে ‘বৃহৎ জনগোষ্ঠী’ বললে কেমন লাগবে: সন্তু লারমা

বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক আয়োজিত সভায় বক্তব্য দেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)ছবি: প্রথম আলো

‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার না করতে সরকারি নির্দেশনার কড়া সমালোচনা করেছেন জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। তিনি বলেছেন, আদিবাসীদের নিজেদের আদিবাসী হিসেবে পরিচয় দেওয়ার মৌলিক অধিকার রয়েছে। বাঙালিদের ‘বাঙালি’ না বলে ‘বৃহৎ জনগোষ্ঠী’ বললে কেমন লাগবে?

আজ বুধবার বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দিতে গিয়ে এ কথা বলেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা।

৯ আগস্ট ছিল আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। দিবসটি পালন উপলক্ষে ‘ঐতিহ্যগত বিদ্যা সংরক্ষণ ও বিকাশে আদিবাসী নারীসমাজের ভূমিকা’ শীর্ষক এ আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। রাজধানীর কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ের ডেইলি স্টার ভবনে এ সভা হয়।

গত ১৯ জুলাই তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ছোট সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা নৃগোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ অবস্থায় আগামী ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত টক শোতে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ, সংবাদপত্রের সম্পাদকসহ সুশীল সমাজের অন্য ব্যক্তিদের বাংলাদেশের ক্ষেত্রে “আদিবাসী” শব্দটি ব্যবহার না করার বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে প্রচারের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’

এ ব্যাপারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সন্তু লারমা বলেন, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যদি জনমানুষের শাসনব্যবস্থা থাকত, তাহলে সরকারের বিশেষ মহলের দৃষ্টিভঙ্গি কোনো মন্ত্রণালয়ের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হতো না। সংবিধানপরিপন্থী উল্লেখ করে আদিবাসী শব্দটিকে গণমাধ্যম, টক শো ও প্রশাসনিকভাবে ব্যবহার না করার নির্দেশ জারি হয়েছে। সরকার একটি শব্দ নিয়ে নানাভাবে তার প্রশাসন যন্ত্র ব্যবহার করছে। সন্তু লারমা প্রশ্ন করেন, এ সরকারকে কি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, গণমুখী, দুর্নীতিমুক্ত বলে আখ্যায়িত করা যাবে? তিনি বলেন, তথাকথিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এ সরকার গঠিত হয়েছে। সরকার সাম্প্রদায়িক, অগণতান্ত্রিক, প্রগতিবিরোধী, ধনী-গরিবের বৈষম্যের স্বীকৃতি দেয় এবং মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে বিভক্ত সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে।

আদিবাসীদের প্রশাসনিকভাবে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত করানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন সন্তু লারমা। তিনি বলেন, ‘আদিবাসীদের পরিচিতি নিয়ে টানাপোড়েন চলছে। আমি আমার পরিচয় দিতে চাই। কী নামে পরিচিত হব, সেটা আমার মৌলিক অধিকার। সরকার তো সে স্বীকৃতি দিচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘১৯৭২-এর সংবিধানে বলা আছে, বাংলাদেশে যারা বাস করবে, তারা বাঙালি হিসেবে পরিচিত হবে। সেখানেই আদিবাসীদের পরিচয় চিহ্নিত হয়ে গেছে। পরবর্তী সময়ে নানা সংশোধনের মাধ্যমে সংখ্যালঘু বহু জাতির আদিবাসীদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, উপজাতি নানা নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের বাঙালি না বলে যদি আমরা বৃহৎ জনগোষ্ঠী বলে ডাকি, তখন কেমন লাগবে তাদের কাছে?’

নারীদের অধিকার নিয়ে সন্তু লারমা বলেন, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নারীকে যথাযোগ্য সম্মান ও অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এখন সেই রাজনীতিতে যেতে হবে, যে রাজনীতি নারীর প্রতিনিধিত্ব স্বীকার করে। দেশে সেই রাজনীতি অত্যন্ত দুর্বল। নারীর সম-অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। সেই লড়াইয়ে যুক্ত হতে হবে পুরুষকে।

অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, সরকার ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল আদিবাসীদের নিরাপদ রাখা। সেটা হয়নি। আদিবাসী শব্দ কেন পরিহার করতে বলা হয়েছে, সেটার কোনো অর্থ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

আরেক অতিথি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, আদিবাসীদের স্বীকৃতির বিষয়টি রাষ্ট্র উপেক্ষা করে গেছে। পর্যটনের প্রসারের নামে, শান্তির নামে নানাভাবে আদিবাসীদের প্রান্তিক অবস্থানের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

অনুষ্ঠানে ‘ঐতিহ্য সংরক্ষণে আদিবাসী নারীদের ভূমিকা’ নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সহসভাপতি চন্দ্রা ত্রিপুরা। প্রবন্ধে বলা হয়, ‘আদিবাসী সমাজে নারীরা অধিক কর্মঠ, উদ্যোগী, নেতৃত্বগুণসম্পন্ন এবং জ্ঞানের ধারক ও বাহক হিসেবে সমাদৃত। তবে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের নামে আদিবাসী নারীরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। নারীরা সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। গত সাত মাসে যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টার ১২টি ঘটনা ঘটেছে।’

‘ঐতিহ্যগত বিদ্যা সংরক্ষণ ও বিকাশে আদিবাসী নারীসমাজের ভূমিকা’ শীর্ষক এ আলোচনা সভায় আলোচকেরা
ছবি: প্রথম আলো

অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, আদিবাসী নারীরা একদিকে নারী হিসেবে; অন্যদিকে আদিবাসী, দরিদ্র, প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী ও ভূমি থেকে স্থানচ্যুত হয়ে অভিবাসী হিসেবে বৈষম্যের শিকার হন।
উন্মুক্ত আলোচনায় হৈমন্তী সরকার নামের এক নারী জানান, উত্ত্যক্ত ও নির্যাতনের ভয়ে জয়পুরহাটে তাঁর এলাকায় তাঁদের জাতিগোষ্ঠীর মেয়েরা এখন নিজেদের ঐতিহ্যগত পোশাক পরতে ভয় পান।

আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, আদিবাসী নারী পরিষদের সভাপতি বাসন্তী মুর্মু, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের কর্মসূচি পরিচালক বনশ্রী মিত্র নিয়োগী, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের উপপরিচালক শাহনাজ সুমী ও বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য রাখী ম্রং।

সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক মিনু মারিয়া ম্রং। স্বাগত বক্তব্য দেন সংগঠনের সদস্য তুলি লাবণ্য ম্রং এবং অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সদস্যসচিব চঞ্চনা চাকমা।