চিড় ধরা সম্পর্কের দায় চিকিৎসক ও সমাজের

প্রাণ গোপাল দত্ত

চিকিৎসকেরা অতীতের মতো এখন আর সমাজের সম্মানজনক অবস্থানে নেই। চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্কে চিড় ধরেছে। এর কিছু দায় চিকিৎসকদের, কিছু দায় সমাজের। জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দৃঢ় নৈতিক অবস্থানই চিকিৎসকদের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে পারে।

গতকাল রোববার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মাসিক কেন্দ্রীয় সেমিনারে দেশের জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের আলোচনায় এসব বিষয় উঠে এসেছে। কেন্দ্রীয় সেমিনারে একক বক্তা ছিলেন বিএসএমএমইউয়ের সাবেক উপাচার্য প্রাণ গোপাল দত্ত। সেমিনারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘যোগাযোগদক্ষতা এবং চিকিৎসক–রোগী সম্পর্ক’।

কিছু হাসপাতালে ‘কাস্টমার সার্ভিস’ চালু হয়েছে। এর অর্থ, রোগীরা তাদের কাছে খদ্দের। খদ্দের বানানোর কারণে হাসপাতালগুলো রোগীদের কাছ থেকে লাভ করতে চায়। আর সেই লাভের প্রক্রিয়ায় চিকিৎসককে যুক্ত হতে বাধ্য করে।
প্রাণ গোপাল দত্ত, সাবেক উপাচার্য, বিএসএমএমইউ

অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, চিকিৎসকের কাছে রোগী হচ্ছেন অতিথি বা দেবতা। যেখানে তিনি পেশাচর্চা করেন, সেই হাসপাতাল হচ্ছে মন্দির। আজ আর তা নেই।

চিকিৎসা কোনো ব্যবসা নয় উল্লেখ করে গোপাল দত্ত বলেন, ‘ব্যবসায়ী–ক্রেতার সম্পর্ক আর চিকিৎসক–রোগীর সম্পর্ক এক নয়। সেবা ১০০ টাকায় কিনে চিকিৎসক তা ১১০ টাকায় বিক্রি করেন না।’

রোগীর সঙ্গে চিকিৎসদের যোগাযোগদক্ষতা বৃদ্ধি, রোগীর সঙ্গে কী আচরণ করা উচিত, চিকিৎসকেরা সেবাদানের সময় কোন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন, সেসব সমস্যা কী করে মোকাবিলা করতে হয় এবং সর্বোপরি রোগীর সঙ্গে কী করে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়, সম্পর্ক ভালো করতে হয়—এসব বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করার জন্য এই সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল।

প্রাণ গোপাল দত্তর একক বক্তৃতার পর একাধিক চিকিৎসক অভিযোগ করেন, সবকিছু ঠিকঠাক থাকার পরও কিছু রোগী বা তাঁদের স্বজনেরা যথাযথ আচরণ করেন না। চিকিৎসককে হেয় চোখে দেখেন, অপমান করেন।

বাংলাদেশে চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্ক যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, অন্য কোথাও ততটা খারাপ দেখা যায় না। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও চিকিৎসক–রোগীর সম্পর্ক অনেক ভালো। সেমিনারের আলোচনার শেষ দিকে বিএসএমএমইউয়ের সহ–উপাচার্য এ কে এম মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘অন্য দেশের চিকিৎসকেরা যে বই পড়েন, আমরাও সেই একই বই পড়ি। তাহলে রোগী দেখার সময় এই পার্থক্য তৈরি হয় কেন?’

বিএসএমএমইউয়ের হেমাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক মাসুদা বেগম প্রশ্ন করেন, একজন চিকিৎসকের পক্ষে দিনে কত রোগী দেখা সম্ভব বা কতজন রোগী দেখা উচিত?

‘২০ জনের বেশি নয়, ১০ মিনিটের কম নয়’ এমন একটি বিষয় বিএসএমএমইউয়ের সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে চালু করা হয়েছে বলে জানান উপাচার্য মো. শারফুদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিনে ২০ জনের বেশি রোগী দেখতে পারবেন না এবং তিনি কোনো রোগীকে ১০ মিনিটের কম সময় দেবেন না, এই নিয়ম চালু করার চেষ্টা চলছে।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সেমিনার উপকমিটির সভাপতি বেলায়েত হোসেন সিদ্দিকী। সেমিনারটিকে ভিন্নধর্মী উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের আত্মসমালোচনা করা দরকার, আমরা কি রোগীর প্রতি ঠিক আচরণ করছি?’

‘হিপোক্রেটিক ওথ’

চিকিৎসকদের নৈতিকতার কথা উঠলেই ‘হিপোক্রেটিক ওথ’ নিয়ে আলোচনা হয়। যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ৪৬০ বছর আগে চিকিৎসকদের নীতি–নৈতিকতার নির্দেশনা দিয়েছিলেন হিপোক্রেট। চিকিৎসকেরা পেশাজীবন শুরুর আগে যে শপথ নেন, সেটাই ‘হিপোক্রেটিক ওথ’। এ বিষয়ে প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, ‘হিপোক্রেটিক ওথে রোগীর স্বার্থকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একজন চিকিৎসকের কাছে অন্য কারও স্বার্থের চেয়ে রোগীর স্বার্থ বড়।’

বর্তমান ব্যবস্থায় চিকিৎসকেরা কী চাপের মধ্যে আছেন, তারও কিছু উদাহরণ তুলে ধরেন নাক–কান–গলা বিশেষজ্ঞ গোপাল দত্ত। তিনি বলেন, কিছু হাসপাতালে ‘কাস্টমার সার্ভিস’ চালু হয়েছে। এর অর্থ, রোগীরা তাদের কাছে খদ্দের। খদ্দের বানানোর কারণে হাসপাতালগুলো রোগীদের কাছ থেকে লাভ করতে চায়। আর সেই লাভের প্রক্রিয়ায় চিকিৎসককে যুক্ত হতে বাধ্য করে।

বর্তমানে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করা চিকিৎসক প্রাণ গোপাল দত্ত এক ঘণ্টার বক্তব্যে নিজের জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। তিনি জানান, একবার ব্যক্তিগত চেম্বার বন্ধ করে বাসায় ফেরার সময় বেশ রাতে এক রোগী এসে হাজির। অনুরোধে আবার চেম্বার খুলে রোগী দেখলেন। যাওয়ার সময় ওই রোগীর আত্মীয়রা বলেছিলেন, এত বড় চিকিৎসক, দেড় শ টাকার লোভ সামলাতে পারলেন না!

চিকিৎসকদের উদ্দেশে প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, ‘রোগী যদি বারবার আপনার কাছে ফিরে আসেন, তাহলে বুঝতে হবে, আপনি ভালো চিকিৎসক নন।’