জোবায়েদ হত্যা: পুলিশের ‘গল্প’ বিশ্বাস হচ্ছে না পরিবারেরও
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জোবায়েদ হোসেন হত্যাকাণ্ডের কারণ হিসেবে পুলিশের বলা ‘ত্রিভুজ প্রেমের গল্প’ নিয়ে আগেই প্রশ্ন তুলেছিলেন তাঁর শিক্ষক। এখন পরিবারও এটাকে ‘সাজানো গল্প’ই মনে করছে। তারা চাইছে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে খুনিদের শাস্তি হোক।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন জোবায়েদ। ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯ অক্টোবর রাতে পুরান ঢাকার আরমানিটোলার একটি ভবনের সিঁড়ি থেকে তাঁর রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তাঁর গলায় ছুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিল।
যে ভবনে জোবায়েদের মরদেহ পাওয়া গিয়েছিল, তার একটি ফ্ল্যাটে বার্জিস শাবনাম বর্ষা নামের এক তরুণীকে পড়াতেন জোবায়েদ। দুই দিন পর পুলিশ বর্ষা (১৮) এবং মাহির রহমান (১৯) ও ফারদীন আহম্মেদ আয়লান (২০) নামের আরও দুই তরুণকে গ্রেপ্তার করে। এরপর সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, বর্ষা–মাহির–জোবায়েদের ত্রিভুজ প্রেমের দ্বন্দ্বে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
পুলিশের এই বক্তব্যের বিষয়ে জোবায়েদের বড় ভাই এনায়েত হোসেন সৈকত প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা একটা সাজানো গল্প। আমাদের জোবায়েদ কখনো এই মেয়েকে পছন্দ করত না। বরং সে বলেছিল, এখানে টিউশনিতে ঝামেলা আছে, আরেকটা টিউশনি পেলে এটা ছেড়ে দেবে। তাহলে সেখানে পছন্দ হওয়ার বিষয় কোথায় থেকে এল?’
ছোট ভাই হলেও জোবায়েদের সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধুর মতো ছিল বলে জানান এনায়েত। কুমিল্লার মুরাদনগর থেকে ঢাকায় এসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর দুই ভাই এক মেসেই থাকতেন। গত বছরের ডিসেম্বরে জোবায়েদ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে পুরান ঢাকার একটি মেসে চলে যান।
এনায়েত বলেন, ‘তার পছন্দ-অপছন্দের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে জিজ্ঞাসা করতাম। কিন্তু পছন্দের কেউ নেই বলে জানায়। এর মধ্যে কয়েকবার ওর মেসে এসেছি, তার রুমমেটদের সঙ্গে চেনাজানা ছিল। সচরাচর সে খুব চাপা স্বভাবের ছিল, কেউ নিজ থেকে কথা না বললে সে কথা বলত না। সব কথার উত্তর দুই–এক শব্দে বলে ফেলত। সে এক বছর ইয়ার গ্যাপ দিয়ে পরবর্তী ব্যাচের সঙ্গে পড়াশোনা চালিয়ে গেছে। তার হাতে সময় ছিল, পড়াশোনার জন্য নিয়মিত তাকে পরামর্শ দিতাম। বিসিএসের প্রতি আগ্রহ ছিল অনেক। পাশাপাশি ব্যাংকের পরীক্ষার জন্যও প্রস্তুতি নিতে বলেছিলাম।’
এনায়েতের সঙ্গে কথা বলার সময় পাশেই ছিলেন তাঁর বাবা মোবারক হোসেন। তিনিও প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরও কখনো মনে হয়নি যে জোবায়েদ কোনো সম্পর্কে জড়িয়েছেন। বড় ভাই এনায়েত ও মায়ের সঙ্গে জোবায়েদ সহজ ছিলেন। তাঁরাও এমন কোনো আভাস পাননি। তাঁর পছন্দের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে জোবায়েদ পড়াশোনা আগে শেষ করার কথাই বলতেন।
পুলিশের সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও দেখেছেন মোবারক। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে মনেই হয় নাই আমার জোবায়েদ এ রকম। ওই মেয়ের পরিবারের সঙ্গে কখনো আমাদের যোগাযোগই হয় নাই। আমার ছেলে পড়াত, সে ছাত্রী, তার সঙ্গে আমাদের কী কথা হবে? পুলিশ আমার ছেলের সঙ্গে বর্ষার সম্পর্কের কথা বলছে। এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এখানে আরও অনেক বিষয় আছে। বর্ষা আমার ছেলেকে মারাইছে। আমি বর্ষার বিচার চাই। সে খুন করুক বা না করুক, সে খুনের সঙ্গে জড়িত। ওই দুইটা ছেলেকে হুকুম দিয়েছে আমার ছেলেকে মারার জন্য।’
ছেলে হারানোর বেদনা নিয়ে মোবারক কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার ছেলে ওই বাড়িতে টিউশনি করত, তার অপরাধ কী ছিল? আমাকে কেন সন্তানহারা হতে হলো? আমার জোবায়েদকে হত্যার সঙ্গে জড়িত সবার বিচার চাই। আমি যদি এতটুকু হায়াত পাই, আমি আমার পুতের (ছেলের) হত্যাকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। এ ছাড়া আমার আর শান্তি হবে না।’
পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, বর্ষার সঙ্গে আগে মাহিরের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এরপর তাঁর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে জোবায়েদের সঙ্গে। সম্প্রতি বর্ষা আবার মাহিরের কাছে ফিরতে চেয়েছিলেন। সেই পথের বাধা কাটাতে এক মাস আগে জোবায়েদকে খুনের পরিকল্পনা করা হয়।
পুলিশের এই বক্তব্যের নানা অসংগতি তুলে ধরে ২২ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. রইছ্ উদ্দীন বলেছিলেন, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সংবাদ সম্মেলন থেকে ‘ত্রিভুজ প্রেমের একটা গল্প’ সাজানো হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে জোবায়েদের চরিত্রহননের চেষ্টা করা হয়েছে।
‘চুপচাপ জোবায়েদ মিশত কম’
জোবায়েদ ছোটবেলা থেকেই চুপচাপ স্বভাবের ছিলেন বলে জানান তাঁর বাবা মোবারক হোসেন। তিনি জানান, জোবায়েদ খুব কম মানুষের সঙ্গে মিশতেন। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে মুরাদনগর আবদুল মজিদ কলেজে পড়াশোনা করেছেন। ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোচিং করেছেন, বড় ভাইয়ের সঙ্গে থাকতেন।
‘জোবায়েদকে আমি কখনো পড়াশোনার জন্য চাপ দিই নাই। সে বলত, “বাবা, আমি পড়াশোনা শেষ করে এলে কিছু একটা করব।” আমারে শুধু এটাই বলত, “আপনারা চিন্তা কইরেন না। যখন যা লাগে, আমি চেষ্টা করব,”’ বলেন তিনি।
মুরাদনগরে বাড়িতে বসেই জোবায়েদের মৃত্যুর খবর পেয়েছিলেন মোবারক। তিনি বলেন, ‘আমার মেজ ছেলে আইসা বলল, “আব্বা, জোবায়েদের খবর নাও। ওর কী হইছে?” ওর বড় ভাইকে কল দিলাম খোঁজ নিতে যে জোবায়েদের কী হইছে? কয়, “আব্বা, আমার সঙ্গে তো কয় দিন কথা হয় নাই। দেখি কী হইছে।” এরপর আমার ভাই আইলো। সে বলে, “ভাই, খবর পাইছেন? আমাদের পুরা ফ্যামিলি সব জেনে গেছে।” তখন আমি বুঝতে পারছি, আমার ছেলের কোনো সমস্যা হইছে। আমার এক ভাই দেখলাম বেহুঁশ হয়ে গেছে, তখন আমি বুঝতে পারছি মারা গেছে। এর মধ্যে আমার ছোট ভাই এসে বলল, “ভাই, আমাদের পরিবার তো শেষ, আমাদের জোবায়েদকে মাইরা ফেলছে।” আমি তখন আমার ছোট ছেলে মুশফিকের মাদ্রাসার সামনে দাঁড়িয়ে। এত জোরে এক চিৎকার দিলাম, মনে হচ্ছিল আমার চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে।’
গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে সরাসরি থানায় গিয়েছিলেন মোবারক। থানায় মরদেহ না পেয়ে যান মিটফোর্ড হাসপাতাল মর্গে। তিনি বলেন, ‘অনেকজনরে কইলাম, আমার জুবুরে একটু দেখান। কেউ দেখার সুযোগ দিচ্ছিল না। পরে একজন আইসা কয় দেখতে। সমস্যা নাই। তখন মর্গে গিয়া জুবুরে দেখলাম। তার চুল ধরতাম চাইছিলাম, তখন কয়, “না, আপনার এখন ধরাটা ঠিক হবে না।” শুধু মনে হচ্ছিল আমার জুবু ঘুমিয়ে আছে। বাড়ি থেকে আসার সময় জুবুর মা বলতেছিল, “আমার জুবুরে নিয়া আইসো, আমার জুবুরে ছাড়া আমি কীভাবে থাকমু, আমার জুবুরে নিয়ে আইসো।” আমার জুবু আর আমার সাথে বাড়িতে যাবে না, আর ফিরে আসবে না। আমার জুবুর মাথায় হাত বুলাতে পারব না।’
শাস্তির দাবি ছাত্রদল নেতার
জোবায়েদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক জাফর আহম্মেদের অনুসারী ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জোবায়েদ দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের সঙ্গে রাজনীতি করত। গত বছর জুলাই আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানের সময় সে আমাদের সঙ্গে ছিল। পাঁচ আগস্ট–পরবর্তী সময়েও সে বিভিন্ন মিটিং–মিছিলে অংশগ্রহণ করত। সর্বশেষ গত বছরের নভেম্বরে তাকে কুমিল্লা জেলা ছাত্রকল্যাণের সভাপতি বানিয়েছিলাম। বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিল জোবায়েদ।’
কিছুদিন ধরে সাংগঠনিক কাজে জোবায়েদে অংশগ্রহণ কম ছিল জানিয়ে জাফর আহম্মেদ বলেন, ‘সর্বশেষ দুই–এক মাস সে কম অংশগ্রহণ করত। তাকে জিজ্ঞাসাও করতাম, কিন্তু কোনো উত্তর দিত না। জি, আচ্ছা ভাই বলে শেষ।’
ছাত্রদলে জোবায়েদের সঙ্গে কারও কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না জানিয়ে জাফর আহম্মেদ বলেন, ‘ছাত্রদল করার কারণে কারও সঙ্গে সে কখনো ঝামেলা জড়ায়নি। বা তার বিরুদ্ধে কখনো কেউ অভিযোগ দেয়নি। তার এই অকালমৃত্যু আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। জোবায়েদ হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের প্রত্যেকের শাস্তির দাবি জানাই।’
যা বললেন তদন্ত কর্মকর্তা
জোবায়েদের বড় ভাই এনায়েত যে হত্যা মামলা করেন, তার তদন্ত করেছেন বংশাল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ আশরাফ। ওই মামলায় বর্ষা, মাহির ও আয়লানকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁরা এখন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে রয়েছেন।
স্বীকারোক্তির সূত্র ধরে তদন্ত কর্মকর্তা আশরাফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘তারা স্বীকার করেছে যে তারা জোবায়েদের হত্যার সঙ্গে জড়িত। এর সঙ্গে একজন সাক্ষীকে আমরা আদালতে উঠিয়েছি, সে মাহিরের বন্ধু প্রীতম। যার সঙ্গে মাহির প্রথমে কল দিয়ে যোগাযোগ করেছিল জোবায়েদ মারা যাওয়ার পর। মাহির প্রীতমকে বলেছিল , “একটা গ্যাঞ্জাম হয়েছে, বাসায় যেতে হবে। তাড়াতাড়ি আয়।” সে তখনো প্রীতমকে জোবায়েদের খুনের বিষয়ে বলেনি। বাসায় যাওয়ার পর মাহির তার মা ও বন্ধু প্রীতমকে জোবায়েদ খুন হওয়ার বিষয়টি জানায়।’
জোবায়েদকে খুন করার সময় ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে মাহিরের ডান হাতের একপাশে কেটে গিয়েছিল জানিয়ে উপপরিদর্শক আশরাফ বলেন, পরে প্রীতম তাকে আদ–দ্বীন হাসপাতালে নিয়ে যান, সেখানে হাতের সেলাই করে বাসায় নিয়ে আসেন। যেহেতু খুন হওয়ার বিষয়ে প্রীতমকে নিজ মুখে মাহির জানিয়েছিল, তাই প্রীতমের জবানবন্দি নেওয়া হয়।
খুনের কারণ হিসেবে আগের অবস্থানেই রয়েছে পুলিশ। তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘এখন আমরা আদালতে পুরো বিষয় নিয়ে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করব। রিপোর্ট জমা দেওয়ার পরে বিচারকাজ শুরু হবে।’