‘এর আগে মেট্রোরেলে উঠি নাই, বাবা বলছিল অনেক টাকা লাগে’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৪তম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবসে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের উদ্যোগে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মেট্রোরেলে চড়ানো হয়। মতিঝিল স্টেশন থেকে উত্তরা দিয়াবাড়ি পর্যন্ত মেট্রোরেল ভ্রমণ করে তারা। ঢাকা, ১৭ মার্চছবি: দীপু মালাকার

রাজধানী ঢাকায় মেট্রোরেল চালুর খবর টেলিভিশনে দেখেছিল রুবিনা (১৪)। অটোরিকশাচালক বাবা মো. রুবেলকে একদিন বলেছিল, মেট্রোরেলে চড়ানোর জন্য। কিন্তু বাবা বলেছিলেন, ‘অনেক টাকা লাগে।’ তবে ভাড়া ঠিক কত, সেটা রুবিনা জানে না। তার ভাষায়, বাবাও জানেন না। কারণ, একবার সে বাবার কাছে ভাড়া কত জানতে চেয়ে উত্তর পেয়েছিল, ‘অনেক টাকা।’ তবে আজ রোববার বিনা ভাড়াতেই রুবিনা আর তার ছোট ভাই জনি (৮) মেট্রোরেলে চড়ার সুযোগ পায়। মেট্রোরেলের একটি বগিতে বসেই কথা হয় রুবিনার সঙ্গে।

রুবিনা আর জনির মতো ৪৮ সুবিধাবঞ্চিত শিশু আজ প্রথমবারের মতো মেট্রোরেলে চড়ার সুযোগ পায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৪তম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে সুবিধাবঞ্চিত এই শিশুদের মেট্রোরেলে আনন্দভ্রমণের আয়োজন করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।

রুবিনা রাজধানীর মান্ডার কদম আলী ঝিলপাড়ে থাকে। কথাকলা কেন্দ্র নামের সংগঠনটিতে যুক্ত। একটি সেলাই কারখানায় কাজ শেষে বিকেলে সে কথাকলা কেন্দ্রের স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। রুবিনার ভাষায়, মেট্রোরেলের সব সুন্দর। স্টেশন। বাইরের দৃশ্য। টেলিভিশনে দেখার মতোই সুন্দর।

মেট্রোরেলের মতিঝিল স্টেশন থেকে বেলা সাড়ে ১১টায় আনন্দভ্রমণের যাত্রা শুরু হয়। দিয়াবাড়িতে উত্তরা উত্তর স্টেশন পর্যন্ত চলে যাত্রা। শিশুরা মান্ডা এলাকার কথাকলা কেন্দ্র, বাদামতলী এলাকার এক মাত্রা এবং সদরঘাট এলাকার আল বারাকা নামের শিশু অধিকারবিষয়ক সংগঠন থেকে এসেছিল। কথাকলা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ইভান আহমেদ জানান, তাঁর সংগঠন থেকে ২১ শিশু আনন্দভ্রমণে যোগ দেয়। সুবিধাবঞ্চিত এই শিশুরা সংগঠনে বেলা তিনটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত পড়াশোনা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকে।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী ভ্রমণ শুরুর আগে মতিঝিল স্টেশনে শিশুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, শিশুদের নিয়ে এ ধরনের আয়োজন অব্যাহত থাকবে।

স্টেশন থেকে রেলে চড়ার সময়ে শিশুরা সমস্বরে বলতে থাকে, ‘শুভ শুভ দিন, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন।’ শিশুদের পরনে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের লোগো লাগানো মেরুন রঙের টি-শার্ট ও মাথায় ক্যাপ ছিল। ছুটির দিন হওয়ায় এবং শেষ স্টেশন হওয়ায় যাত্রীর চাপ ছিল না। রেলের একটি বগির গুটিকয় যাত্রীকে অন্য বগিতে পাঠিয়ে বগিটা শিশুদের জন্য খালি করা হয়। রেল ছাড়ার পর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিল শিশুরা।

আকৃতির তুলনায় বড় মাপের টি শার্ট পরা ৬-৭ বছর বয়সী সাইম ও হাসান গলাগলি করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছিল। একে অপরকে কিছু একটা দেখিয়ে আনন্দ প্রকাশ করছিল। বলছিল, ‘দ্যাখ, দ্যাখ, কী সুন্দর!’ কী দেখছ, জানতে চাইলে জানালা থেকে নজর না সরিয়ে দুজন বলে, ওপর থেকে শহর অন্য রকম লাগছে তাদের কাছে। সবকিছু সুন্দর লাগছে। রুবিনার মতো তারা দুজন রাজধানীর মান্ডার কদম আলী ঝিলপাড়ে থাকে। কথাকলা কেন্দ্রের স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। দুজনের বাবাই রিকশাচালক ও মা গৃহকর্মী।

জীবনে প্রথমবার মেট্রোরেলে চড়তে পেরে উচ্ছ্বসিত সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৪তম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের উদ্যোগে এই শিশুদের মেট্রোরেলে চড়ানো হয়। ঢাকা, ১৭ মার্চ
ছবি: দীপু মালাকার

হাসান জানায়, তারা তিন ভাই, এক বোন। বড় ভাই পারভেজ বেকারিতে কাজ করে। তারা দুই ভাই-বোন আজ মেট্রোতে চড়েছে। সংগঠন থেকে কয়েক দিন আগে জানানো হয়, তাদের মেট্রোতে চড়ানো হবে। তখন থেকেই সে খুশিতে ছিল। আজ সকাল সাড়ে আটটায় তাদের একটি দোতলা বাসে করে মতিঝিল স্টেশনে আনা হয়। বাসা থেকে না খেয়েই এসেছিল। এখানে আসার পর মিষ্টি আর কেক খেতে দেওয়া হয় নাশতায়।
   
হজ্জত (৯) নামের এক শিশু জানায়, সে এসেছে গুলিস্তান থেকে। এক মাত্রা সংগঠনের পথস্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে। পিংকি আক্তার (১২) নামের আরেক শিশু এসেছে বাদামতলী থেকে। ছোটকাটরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। তার বাবা মারা গেছেন। মা পানি বিক্রি করেন। পিংকি জানায়, এই প্রথম মেট্রোরেলে চড়ে তার খুবই ভালো লেগেছে।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের উপসচিব মো. আবু নাছের জানান, মেট্রোরেলে ভ্রমণের পর উত্তরায় শিশুদের বিআরটিসির দোতলা বাসে চড়ানো হয়। সেই বাসে করে শিশুরা শহর দেখতে দেখতে বেলা দুইটার দিকে মতিঝিলে ফিরে আসে। তাদের জন্য দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা ছিল।