‘সব বই বই নয়’

বইমেলা এখন পাঠকের পদভারে সরগরম। তালিকা করে বই কিনতে শুরু করেছেন অনেকেইফাইল ছবি

বেশ বোঝা যায়, খানিক আগে পানি ছিটানো হয়েছে। তবু বাতাসে ধুলার দাপট। এর মধ্যেই কলহাস্য করতে করতে তরুণ–তরুণীরা প্রবেশ করছেন, বিস্তর সেলফি তোলা চলছে। ঘোরাঘুরি, আড্ডাবাজির যেন দারুণ ফুরসত মিলেছে।

পয়লা ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবসের তিন দিন আগে গতকাল শনিবার সরকারি ছুটির দিনে এই হলো অমর একুশে বইমেলার দৃশ্যপট।

বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত ছিল শিশুপ্রহর। তার রেশ যেন দুপুরের পরও চলল। সিসিমপুরের স্টলের সামনে শিশু ও অভিভাবকদের বেজায় ভিড়। শিশুরা হাঁটছিল মা–বাবার হাত ধরে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত কোনো কোনো শিশু বায়নাও ধরল কোলে ওঠার।

বিকেল চারটায় বইমেলার বাংলা একাডেমির প্রান্তের মূল মঞ্চে প্রবন্ধ পাঠ, আলোচনা ও কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠের প্রস্তুতি চলছিল। সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের স্টল এই দিকটায়। ভিড় এখানেও কম ছিল না, কম ছিল বেচাকেনা।

দুই তরুণের আগ্রহ

কথাপ্রকাশের স্টলে কথা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম তাহমিন ও তাকিম রহমানের সঙ্গে। জাহিদুলের আগ্রহ ইতিহাস ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে। আর তাকিমের প্রিয় বিষয় রাষ্ট্রব্যবস্থা ও ভূরাজনীতি। দুজনই একটি বা দুটি বই কিনেছেন, আরও কেনার কথা ভাবছেন। এই স্টলের বিক্রয়কর্মীও জানালেন, ননফিকশন বইয়ের প্রতি জাহিদুল ও তাকিমের মতো একশ্রেণির পাঠকের আগ্রহের কথা। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সাতচল্লিশের দেশভাগে গান্ধী ও জিন্নাহ বইটির কথা বিশেষভাবে বললেন তিনি।

মাওলা ব্রাদার্সের বিক্রয়কর্মী তামিম আল রাজী আলাদাভাবে তাদের দুটি বইয়ের নাম করলেন। কাবেদুল ইসলামের গণপরিষদ বিতর্কের আলোকে, বাংলাদেশের সংবিধানের জন্মকথা ও ফিওদর দস্তইয়েফ্‌স্কির তলকুঠুরির কড়চা, যা রুশ ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন মশিউল আলম।

অপরদিকে পার্ল প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী জানান, তাঁদের থ্রিলারধর্মী বইগুলোই পাঠক বেশি নিচ্ছেন।

মানসম্মত বই সময়ের দাবি

সাম্প্রতিক সময়ে সাহিতি৵ক–লেখক অনেকেই বই সম্পাদনার ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন। প্রকাশকদের অবশ্যই বইয়ের সম্পাদকমণ্ডলী থাকা উচিত বলে তাঁরা মতপ্রকাশ করেছেন। গতকাল বইমেলায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে পাওয়া গেল লেখক, গবেষক অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর দে–কে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই উপাচার্যও বললেন, ‘সব বই বই নয়। মেলায় যেন প্রকৃত বই আসে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।’ তাঁর প্রস্তাব, বাংলা একাডেমি যখন স্টল বরাদ্দের আবেদনপত্র আহবান করবে, সেই আবেদনপত্রেই বইয়ের সম্পাদকের নাম প্রকাশকেরা উল্লেখ করবেন, এমন ব্যবস্থা থাকা দরকার।

এ বিষয়ে প্রকাশকদের ভাবনা কী? মেলার মূল অংশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আগামী প্রকাশনীর স্টলে ছিলেন জ্যেষ্ঠ প্রকাশক ওসমান গণি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘বই বইয়ের মতো হওয়া দরকার। এমন বই প্রকাশ করার দরকার নেই, যেন মনে হয় কাগজ নষ্ট হয়েছে।’ তিনি বলেন, সম্পাদনা পরিষদ অবশ্যই থাকা দরকার। বইমেলায় অংশ নিয়েছেন ৬৩৫ প্রকাশক; কিন্তু সম্পাদনা পরিষদ রাখার মতো আর্থিক সক্ষমতা আছে বড়জোর ২৫ প্রকাশকের। আবার সম্পাদক পরিষদ যে দরকার, এটা চিন্তা করার ক্ষমতাও অনেকের নেই। তাই যদি হতো, তবে পাইরেটেড, অনুমোদনহীন বই মেলায় বিক্রি হতো না। ওসমান গণির মতে, ‘মানসম্মত বই এখন সময়ের দাবি। এ কারণে বাংলা একাডেমিকে বইমেলার নতুন করে বিন্যাস করার কথা ভাবতে হবে।’

প্রথমায় নতুন দুই উপন্যাস

গতকাল প্রথমা প্রকাশনে নতুন বই এসেছে দুটি। দুটিই উপন্যাস। আনোয়ারা সৈয়দ হকের নিঃসঙ্গ পিরামিড এবং হরিশঙ্কর জলদাসের একটু দাঁড়াও। প্রথমার ব্যবস্থাপক জাকির হোসেন জানান, আসিফ নজরুলের আমিই আবু বকর ও আনিসুল হকের কখনো আমার মাকে প্রতিদিনই ভালো বিক্রি হচ্ছে। প্রথমার পুরোনো বইগুলোর মধ্যে বেশি বিকোচ্ছে আরভিং স্টোনের জীবন–তৃষা, অনুবাদ অদ্বৈত মল্লবর্মণ; আবুল বাসারের ভাষান্তরে মিচিও কাকুর ফিজিকস অব দ্য ইমপসিবল। গতকাল ভালো বিক্রি হয়েছে প্র–প্রকাশনের বই সুমন্ত আসলামের পাঁচজন দুষ্টু ছেলে।

বাংলা একাডেমির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গতকাল মেলায় নতুন বই এসেছে ১৫২টি। উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে আহমাদ মোস্তফা কামালের জলের অক্ষরে লেখা এনেছে পাঠক সমাবেশ, সুমন সাজ্জাদের শব্দ রম্য এনেছে কথাপ্রকাশ, সৌরভ মাহমুদের বাংলার ও জীবনানন্দের শালিকেরা বের করেছে মাছরাঙা, মুহাম্মদ আব্দুস সালামের চীন একটি দেশ একটি পৃথিবী প্রকাশ করেছে পুঁথিনিলয়।

দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন

দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন স্টিফেন হকিং ও লিওনার্ড ম্লোডিনো প্রথমা প্রকাশন

মহাবিশ্বের নিয়মকানুন সূক্ষ্মভাবে সমন্বয় করা। তা এতই সূক্ষ্ম যে একে বলা চলে শ্রেষ্ঠ নকশা বা গ্র্যান্ড ডিজাইন। কিন্তু এ ডিজাইনের অর্থ কী? তা কি আমাদের মতো জীবসত্তার অস্তিত্বের প্রয়োজনে? নাকি রয়েছে অন্য কোনো কারণ? এসব জিজ্ঞাসা ও রহস্যের ব্যাখ্যা আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে দিয়েছেন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং এবং লিওনার্ড ম্লোডিনো। তাঁরা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন কোয়ান্টাম তত্ত্ব, আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এবং হালের বহুল আলোচিত এম-থিওরির ভিত্তিতে। তা বর্ণনা করেছেন সাধারণ পাঠকের উপযোগী সহজ-সরল ভাষায়। হকিংয়ের অন্যতম জনপ্রিয় বইটি একসময় ছিল আমাজন বেস্টসেলারের তালিকায়। গভীর ভাবনায় সমৃদ্ধ, আকারে সংক্ষিপ্ত এ বই নতুন ভাবনা উসকে দেবে।