তেজগাঁও রাজধানীর সবচেয়ে বেশি অপরাধপ্রবণ এলাকা, কম রমনা

রাজধানীর ৫০ থানাকে আটটি অপরাধ বিভাগে ভাগ করে কাজ করছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। পুলিশের তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, তেজগাঁও বিভাগে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণ ও মাদকের কারবার সবচেয়ে বেশি।

অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর ৫০ থানাকে আটটি অপরাধ বিভাগে ভাগ করে কাজ করছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)ফাইল ছবি

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগ রাজধানীর সবচেয়ে বেশি অপরাধপ্রবণ এলাকা। এরপরই আছে যথাক্রমে ওয়ারী, মিরপুর, উত্তরা, লালবাগ, গুলশান, মতিঝিল ও রমনা বিভাগ। ডিএমপির করা গত সাড়ে তিন বছরের (২০২০-২০২৩ জু্ন) তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিটি বিভাগেই আগের বছরের তুলনায় অপরাধ বেড়েছে।

অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর ৫০ থানাকে আটটি অপরাধ বিভাগে ভাগ করে কাজ করছে ডিএমপি। পুলিশের তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, তেজগাঁও বিভাগে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণ ও মাদকের কারবার সবচেয়ে বেশি। ওয়ারী বিভাগে খুন ও ধর্ষণের ঘটনা বেশি। মিরপুরে বেশি চাঁদাবাজি। উত্তরা বিভাগে চোরাচালান, লালবাগে বিস্ফোরক দ্রব্য, গুলশান বিভাগে দাঙ্গা ও রাজনৈতিক খুনের মতো ঘটনা বেশি।

গত ১ জুলাই রাজধানীর ফার্মগেটে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের এক কনস্টেবল মনির হোসেন তালুকদার নিহত হন। এর পর থেকে ডিএমপি রাজধানীজুড়ে বিশেষ অভিযান শুরু করে। তবে এর মধ্যেও নগরীতে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে মানুষ হতাহত হচ্ছেন। ডিএমপির কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানীর যেসব এলাকায় বস্তি, নিম্ন আয় ও ভাসমান মানুষের বসবাস বেশি, সেখানে অপরাধের ঘটনা বেশি। স্থানভেদে ভৌগোলিক অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এলাকাগুলোতে অপরাধের ধরন একেক এলাকায় একেক রকম।

পাঁচ ধরনের অপরাধ তেজগাঁওয়ে

ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের অধীন থানা ছয়টি তেজগাঁও, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, হাতিরঝিল, শেরেবাংলা নগর, আদাবর ও মোহাম্মদপুর। মোহাম্মদপুরের বছিলা ও বেড়িবাঁধ এলাকা এবং আদাবর ও শেরেবাংলা নগর থানা এলাকায় বস্তি রয়েছে। সেখানে ভাসমান ও নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস বেশি। এদের একটি বড় অংশ অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। গত সাড়ে তিন বছরে তেজগাঁও বিভাগে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪৬১টি চুরির (সিঁধেল ও গাড়ি চুরিসহ) মামলা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ২৬০টি ছিনতাই, ২০টি ডাকাতি, ৩৮টি অপহরণের মামলা হয়েছে এখানে। পুলিশের হিসাবে সর্বাধিক ৮ হাজার ৪০৫টি মাদক দ্রব্য আইনে মামলা হয়েছে তেজগাঁও বিভাগে।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত তেজগাঁও বিভাগে ১৬৯টি চুরির ঘটনা ঘটেছে। আগের বছর ২০২২ সালে এক বছরে ঘটে ৩৫৯টি চুরি। ২০২১ সালে তেজগাঁও বিভাগে ২৬৪টি চুরির ঘটনা ঘটে। আর ২০২০ সালে এই সংখ্যা ছিল ২১৯। গত ৬ মাসে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে ৬৫টি। আগের বছর এক বছরে ৭২টি। আর ২০২১ সালে ৬১টি এবং ২০২০ সালে এই বিভাগে ৬২টি ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছিল। একইভাবে ডাকাতি, অপহরণ ও খুন-ধর্ষণের ঘটনাও বাড়ছে।

সাসপেক্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম (এসআইভিএস) নামের একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছে ডিএমপির তথ্যভান্ডার। এতে রাজধানীতে ডাকাতির ঘটনায় ৪ হাজার ৪৬১ জন ও ছিনতাইয়ে ১ হাজার ৭৩৭ জন যুক্ত থাকার তথ্য উল্লেখ রয়েছে। সবচেয়ে বেশি তালিকাভুক্ত ছিনতাইকারী ও ডাকাত রয়েছে এই তেজগাঁও বিভাগেই।

এ বছরের ২৬ এপ্রিল রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার অধীন ঢাকা উদ্যান এলাকা থেকে ‘আম কিনে’ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে এক শিশুকে অপহরণ করে অনলাইনে বিক্রির বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। এরপর মাত্র দুই লাখ টাকার বিনিময়ে তিন বছরের শিশুটিকে গোপালগঞ্জে বিক্রি করে দেয় একটি চক্র। র‍্যাব-২–এর একটি দল শিশু কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত সুজন সুতার নামের এক ব্যক্তিকে ঢাকার শাহবাগ থেকে গ্রেপ্তার করে। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ১৮ মে অপহৃত শিশুটিকে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার তাড়াসি গ্রাম থেকে উদ্ধার করা হয়। এর সঙ্গে জড়িত অভিযোগে শিশুটির ক্রেতা এবং অপহরণকারী চক্রের হোতা পীযূষ দম্পতিসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব।

নারায়ণগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জের সীমানা পড়েছে ওয়ারী বিভাগে। এমন এলাকায় খুন বেশি হয়। লাশগুলো নদীপথে এই এলাকায় ভেসে আসে। দূরবর্তী স্থানে খুন করে লাশ গুম করার জন্য এই এলাকা নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নেয় খুনিরা।
জিয়াউল আহসান তালুকদার, ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার এইচ এম আজিমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘তেজগাঁও রেললাইন ও মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ বস্তি এলাকা। এখানে ভাসমান লোক অনেক বেশি। যেখানে ভাসমান লোক বেশি, সেখানে মাদক বেচাকেনা বেশি। এরা ধরা পড়ার কারণে মামলাও বেশি।’ তবে চুরি, ছিনতাই ডাকাতি এখন কমে এসেছে বলে দাবি তাঁর।

ওয়ারীতে ধর্ষণ ও খুন বেশি

ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের ছয়টি থানা হলো ওয়ারী, ডেমরা, শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ী, গেন্ডারিয়া ও কদমতলী। গত সাড়ে তিন বছরে ওয়ারী বিভাগে সর্বাধিক ১২২টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের ঘটনা এই বিভাগে সবচেয়ে বেশি। এই সময়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩০০ জন। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ছয় মাসেই খুনের ঘটনা ঘটে ২০টি। গত বছরে এই সংখ্যা ছিল ৩৭। ২০২১ সালে খুন হয়েছিল ৩৫ জন। এর আগের বছর সংখ্যাটি ছিল ৩২। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ওয়ারী বিভাগে ধর্ষণের ঘটে ২৯টি। ২০২২ সালে এ ধরনের অপরাধে মামলা হয়েছিল ৮৫টি। ২০২১ সালে ৯৮ এবং ২০২০ সালে ছিল ৮৮।

এ বছরের মার্চ-এপ্রিলে ২০ দিনের ব্যবধানে রাজধানীর ডেমরার আমুলিয়া মডেল টাউন এলাকায় দুজন রিকশাচালককে হত্যা করা হয়। পুলিশ জানায়, গত ২ এপ্রিল রাতে ডেমরার আমুলিয়া মডেল টাউন এলাকায় স্বপন নামের এক রিকশাচালকে শ্বাস রোধ করে হত্যা করে রিকশাটি ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এর আগে ১৩ মার্চ একই এলাকায় আরেক রিকশাচালকে একইভাবে হত্যা করে তাঁরও রিকশাটিও ছিনিয়ে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।

গত সাড়ে তিন বছরে ডিএমপির অপরাধগুলোর মধ্যে এই বিভাগে সবচেয়ে বেশি ৬২টি চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটেছে মিরপুর বিভাগে। এখানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অপরাধ খুন ১০১ ও ধর্ষণের ২৯৮টি মামলা হয়েছে সাড়ে তিন বছরে।

ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার মো. জিয়াউল আহসান তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, নারায়ণগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জের সীমানা পড়েছে ওয়ারী বিভাগে। এমন এলাকায় খুন বেশি হয়। লাশগুলো নদীপথে এই এলাকায় ভেসে আসে। দূরবর্তী স্থানে খুন করে লাশ গুম করার জন্য এই এলাকা নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নেয় খুনিরা। ডেমরা ও কদমতলী এলাকায় এ ধরনের ঘটনা বেশি, অন্য এলাকায় আবার কম।

পুলিশ কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান বলেন, বাসস্ট্যান্ড ও টার্মিনাল এলাকায় ভাসমান লোকের বিচরণ বেশি। তাদের একটা অংশ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। দুই থানার মাঝামাঝি এলাকার সুযোগ নিয়ে অপরাধ করে অপরাধীরা বাসে ওঠে সহজে চলে যেতে পারে। তবে সব অপরাধের ঘটনারই তদন্ত হয়, আসামিও গ্রেপ্তার হয়। ওয়ারী এলাকায় ধর্ষণ বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে জিয়াউল আহসান বলেন, ঢাকার প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ায় এখানে বাসাভাড়া তুলনামূলক কম। অপরাধীরা বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে এ এলাকায় সহজেই বাসা ভাড়া নিয়ে ধর্ষণ করে চলে যায়। একেক অপরাধের পেছনে একেক ধরনের কারণ থাকে।

চাঁদাবাজি বেশি মিরপুরে

মিরপুরের পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, এ এলাকায় অর্ধকোটি মানুষের বাস। নিম্ন ও মধ্যআয়ের মানুষের বসবাসের পাশাপাশি এখানে বস্তি বেশি। এ এলাকায় অনেকগুলো বিপণিবিতান গড়ে উঠেছে। পল্লবী থানা এলাকায় বিহারি ক্যাম্প রয়েছে। মিরপুরের বিভিন্ন জায়গায় মাদকের আখড়া রয়েছে। সব মিলিয়ে ডিএমপির অন্য বিভাগের চেয়ে এখানে চাঁদাবাজি সবচেয়ে বেশি। এর সঙ্গে খুন ও ধর্ষণের মতো অপরাধও ঘটছে।

মিরপুর বিভাগের থানাগুলো হলো মিরপুর, দারুসসালাম, শাহ আলী, রূপনগর, পল্লবী ও কাফরুল। গত সাড়ে তিন বছরে ডিএমপির অপরাধগুলোর মধ্যে এই বিভাগে সবচেয়ে বেশি ৬২টি চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটেছে। এখানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অপরাধ খুন ১০১ ও ধর্ষণের ২৯৮টি মামলা হয়েছে সাড়ে তিন বছরে। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে ছয়টি চাঁদাবাজি, আগের বছর ৩৬টি, ২০২১ সালে ১১ এবং ২০২০ সালে চাঁদাবাজির মামলা হয়েছিল ৯টি।

পুলিশ বলছে, গুলশানে সড়ক দুর্ঘটনার প্রবণতা তুলনামূলক বেশি। এর একটা বড় কারণ গভীর রাতে দামি গাড়ি নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। ‘ড্রাগ রেস’ নামের এ প্রতিযোগিতায় নেমে গুলশান, বনানী ও বিমানবন্দর সড়কে বিকট শব্দ করে ছুটে চলে এসব গাড়ি।

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে এই বিভাগে ১১টি খুনের মামলা হয়েছে। আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ৩১। ২০২১ সালে ২৬ এবং ২০২০ সালে ৩৩টি খুনের মামলা হয়েছে। গত ২৪ এপ্রিল কয়েকজন চাঁদাবাজ মিরপুরের বড়বাগ বসতি হাউজিং এলাকার বাসিন্দাদের কাছে ঈদসালামির নামে চাঁদাবাজি করতে যায়। চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় সন্ত্রাসীরা প্রাণনাশের হুমকি দিলে মিরপুর মডেল থানায় অভিযোগ করা হয়। পুলিশ চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত অভিযোগে মো. শাকিল আহমেদ (৩০) ও আশফাকুর রহমান ওরফে সজীব (২৮) নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশ বলছে, এঁরা চাঁদাবাজ চক্রের সদস্য। গ্রেপ্তার শাকিলের বিরুদ্ধে মিরপুর মডেল থানায় এক পোশাকশ্রমিককে দলবদ্ধ ধর্ষণের মামলা আর আশফাকুর বিরুদ্ধে একই থানায় অস্ত্র আইনে মামলা রয়েছে।

মিরপুর বিভাগে সবচেয়ে বেশি চাঁদাবাজি কেন জানতে চাইলে পুলিশের উপকমিশনার মো. জসীম উদ্দীন মোল্লা বলেন, সংঘটিত অপরাধগুলোর এজাহার না দেখে এবং তা বিশ্লেষণ না করে অপরাধ ঘটার কারণ সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করবেন না। তবে চাঁদাবাজি, খুন ও ধর্ষণের মতো যেকোনো অপরাধ ঘটলে তা মামলা হিসেবে নেওয়া হয়, তদন্তও করা হয়।

রাজধানীর গুলশান ২ নম্বর গোলচত্বর এলাকা
ফাইল ছবি

গুলশানে খুনোখুনির ঘটনা বেশি

ডিএমপির গুলশান বিভাগের থানাগুলো হলো গুলশান, বনানী, ক্যান্টনমেন্ট, খিলক্ষেত, বাড্ডা ও ভাটারা। বনানী থানার অধীন বনানীর সাততলা বস্তি ও কড়াইল বস্তি। পুলিশ বলছে, বাড্ডা ও ভাটারায় জমিজমা-সংক্রান্ত বিরোধ ও রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বেশি খুনোখুনির ঘটনা ঘটে।

ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী, গত সাড়ে তিন বছরে গুলশানে দাঙ্গা ও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বেশি। এই বিভাগে রাজনৈতিক খুনের একটি ও দাঙ্গায় নিহত দুজনের বিরুদ্ধে মোট তিনটি মামলা হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই বিভাগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। তৃতীয় সর্বোচ্চ হিসেবে তালিকায় রয়েছে ৯১টি হত্যাকাণ্ড। ডিএমপির অন্য বিভাগগুলোতে রাজনৈতিক ও দাঙ্গায় খুন হয়নি।

গুলশান থানার একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, দাঙ্গায় খুন মূলত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। সাধারণত রাজনৈতিক দুই দলের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।  

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে মতিঝিল বিভাগে ২৬টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। আগের বছর ধর্ষণ মামলার ছিল ৯৬। ২০২১ সালে ৭৯ এবং ২০২০ সালে ধর্ষণের মামলা হয় ৭৫টি।

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে গুলশান বিভাগে ১১টি খুনের মামলা হয়েছে। গত বছরে ২০ খুনের মধ্যে একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড রয়েছে। ২০২১ সালে ২৪টি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দাঙ্গায় দুজন নিহত হন। আর ২০২০ সালে ৩৩টি খুনের মধ্যে দাঙ্গায় একজন নিহত হন। চলতি বছরের ছয় মাসে গুলশানে চারটি ডাকাতির মামলা হয়েছে। আগের বছর তিনটি আর ২০২০ সালে পাঁচটি ডাকাতির মামলা হয়েছে। ২০২১ সালে এখানে ডাকাতির মামলা ছিল না।

পুলিশ বলছে, গুলশানে সড়ক দুর্ঘটনার প্রবণতা তুলনামূলক বেশি। এর একটা বড় কারণ গভীর রাতে দামি গাড়ি নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। ‘ড্রাগ রেস’ নামের এ প্রতিযোগিতায় নেমে গুলশান, বনানী ও বিমানবন্দর সড়কে বিকট শব্দ করে ছুটে চলে এসব গাড়ি। রাত হলেই গুলশান এলাকায় গাড়ি নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামা অনেকগুলো গাড়ির মালিকদের সতর্কও করা হয়েছে। গুলশান থানার একজন কর্মকর্তা বলেন, মামলা দেওয়ায় ‘রেসিং’ অনেকাংশে কমেছে। রাতে রাস্তা ফাঁকা পেলে অনেকেই বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতেন। এতে দুর্ঘটনা ঘটে।

শাপলা চত্বর, মতিঝিল, ঢাকা
ফাইল ছবি

সব অপরাধই আছে মতিঝিলে

পুলিশ বলছে, মতিঝিল বিভাগের পল্টন ও মতিঝিল থানা এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি। সেখানে চুরির ঘটনা বেশি ঘটে, যাকে পুলিশ সিঁধেল চুরির আওতায় ফেলে। এ বিভাগের সবুজবাগ, খিলগাঁও, মুগদা ও রামপুরার বেশির ভাগ এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ। নিম্নআয়ের মানুষের বসবাস বেশি। দরিদ্র পরিবারের নারী ও শিশুরা বাইরে গিয়ে নানা কাজ করে সংসার চালায়। এসব এলাকায় ধর্ষণের ঘটনা বেশি।

আরও পড়ুন

ডিএমপির মতিঝিল বিভাগে সাতটি থানা পল্টন, মতিঝিল, শাজাহানপুর, সবুজবাগ, রামপুরা, মুগদা ও খিলগাঁও। গত সাড়ে তিন বছরে এই বিভাগে চুরি ও ধর্ষণের মামলা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ যথাক্রমে ১ হাজার ১৪৪ এবং ২৭৬। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে মতিঝিল বিভাগে সিঁধেল চুরিসহ ১৪৩ চুরির মামলা হয়েছে। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৭৭। ২০২১ সালে ৩২৪ এবং ২০২০ সালে ১৭৩টি চুরির মামলা রেকর্ড করা হয়। এ ছাড়া এ বছরের প্রথম ছয় মাসে মতিঝিল বিভাগে ২৬টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। আগের বছর ছিল ৯৬। ২০২১ সালে ৭৯ এবং ২০২০ সালে ধর্ষণের মামলা হয় ৭৫টি।

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে গুলশান বিভাগে ১১টি খুনের মামলা হয়েছে। গত বছরে ২০ খুনের মধ্যে একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড রয়েছে। ২০২১ সালে ২৪টি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দাঙ্গায় দুজন নিহত হন। আর ২০২০ সালে ৩৩টি খুনের মধ্যে দাঙ্গায় একজন নিহত হন।

গত বছরের ১৩ এপ্রিল এক নারীকে সৌদি আরব পাঠানোর কথা বলে মৌলভীবাজার থেকে ঢাকার রামপুরায় এনে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে। পরে র‍্যাব-৩–এর একটি দল অভিযান চালিয়ে তোফায়েল আহম্মেদ, কামরুল আহম্মেদ, খালেদ মাসুদ হেলাল ও মো. জামাল হোসেন নামের তিন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে।

বিমানবন্দরকেন্দ্রিক চোরাচালান বেশি

বিমানবন্দর, উত্তরা পূর্ব–পশ্চিম, উত্তরা পূর্ব, তুরাগ, উত্তরখান ও দক্ষিণ খান নিয়ে ডিএমপির উত্তরা বিভাগ। উত্তরা বিভাগের অধীন হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এই বিভাগে চোরাচালানের মামলা সর্বোচ্চ আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ডাকাতির মামলা। পুলিশ বলছে, দেশি-বিদেশি চোরাকারবারিরা বিমানবন্দরকে চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহার করে।

রাজধানীর একেক এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মান একেক রকম। যেমন গুলশানে উচ্চবিত্তের বসবাস আর মোহাম্মদপুর এলাকায় নিম্ন মধ্যবিত্তের বাস। স্থানভেদে ভৌগোলিক অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এলাকাগুলোতে অপরাধের ধরন একেক এলাকায় একেক রকম।
খঃ মহিদ উদ্দিন, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস)

গত ২০ মে রাত ১০টার দিকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গারের সামনে থেকে ৮ কেজি ওজনের ৬৮ সোনার বারসহ এয়ারক্রাফট মেকানিক শফিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে বিমানবন্দরে কর্মরত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। উদ্ধার করা সোনার বাজারদর ৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

আরও পড়ুন

ডিএমপির তথ্যানুযায়ী, গত সাড়ে তিন বছরে ডিএমপিতে চোরাচালানের ঘটনায় মোট ৪৬২টি মামলা হয়েছে। এই সময়ে উত্তরা বিভাগেই চোরাচালানির মামলার সংখ্যা ৩৬৮। একই সময়ে এই বিভাগে ডাকাতির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মামলা ১৮টি। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে উত্তরা বিভাগে চোরাচালানের ঘটনায় ৪৭টি মামলা হয়েছিল। আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ১৩৭। ২০২১ সালে ১৩৬ এবং ২০২০ সালে ৪৮।  

ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া

ডিএমপির রমনা বিভাগের আওতাধীন থানাগুলো হলো রমনা, শাহবাগ, কলাবাগান, শাহবাগ, ধানমন্ডি ও হাজারীবাগ। ডিএমপির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত সাড়ে তিন বছরে এই বিভাগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১১৬টি ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে। চলতি বছরের ছয় মাসে ১৪টি, আগের বছর ২৮; ২০২১ সালে ৩৪ এবং ২০২০ সালে ৪০টি ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে।

ফার্মগেটে ছিনতাইকারীর হাতে পুলিশ হত্যার পর গত ১ জুলাই থেকে রাজধানীতে বিশেষ অভিযান শুরু হয়। তবু ছিনতাই রোধ করতে পারছে না পুলিশ। গত ১৬ জুলাই রাতে ছিনতাইকারীরা রাজধানীর ধানমন্ডি মিরপুর রোডসংলগ্ন শেখ জামাল মাঠের পূর্ব পাশে নার্সারির ফুটপাতে আদনান সাঈদ ওরফে রাকিব (১৮) নামের এক কলেজছাত্রকে ছুরি মেরে হত্যা করে। তিনি ধানমন্ডি আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়তেন। ১৯ জুলাই গভীর রাতে রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে জাকির হোসেন (৪৩) নামের এক ব্যক্তি এবং তাঁর ছেলে জসিম উদ্দিন (১৭) আহত হয়েছেন। কারওয়ান বাজারে তাঁদের মুরগির দোকান আছে।

লালবাগে বিস্ফোরকের মামলা বেশি

লালবাগ বিভাগের পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, পুরান ঢাকার লালবাগ, চকবাজারসহ আশপাশের দোকানে আতশবাজি ও পটকা বেচাকেনা হয়। এ ছাড়া ওই এলাকার কিছু দোকানে গোপনে বিস্ফোরক বিক্রি করা হয়। এ কারণে ডিএমপির অপরাধ বিভাগগুলোর মধ্যে লালবাগ বিভাগে বিস্ফোরকের মামলা সর্বোচ্চ। এখানে মাদকদ্রব্য উদ্ধার মামলা দ্বিতীয় সর্বাধিক।

ডিএমপির পরিসংখ্যান বলছে, গত সাড়ে তিন বছরে বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনায় ডিএমপিতে ২৮৭টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে লালবাগ বিভাগেই বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলার সংখ্যা ১৩২। পুলিশ এই বিভাগে মাদকদ্রব্য আইনে মামলা করেছে ৭ হাজার ৮৮৪টি।

লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মো. জাফর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে বিস্ফোরক দিয়ে আতশবাজি ও পটকা তৈরি করা হয় লালবাগ এলাকায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অভিযানের কারণে আতশবাজি ও পটকা তৈরির ঘটনা কমে গেছে।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) খঃ মহিদ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, রাজধানীর একেক এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মান একেক রকম। যেমন গুলশানে উচ্চবিত্তের বসবাস আর মোহাম্মদপুর এলাকায় নিম্ন মধ্যবিত্তের বাস। স্থানভেদে ভৌগোলিক অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এলাকাগুলোতে অপরাধের ধরন একেক এলাকায় একেক রকম। তিনি বলেন, ঢাকাসহ একাধিক জেলার প্রবেশপথ মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ দিয়ে। কাজেই এ এলাকায় কোনো ঘটনা ঘটিয়ে অপরাধীরা সহজেই ঢাকা থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। তবে ডিএমপি সংঘটিত অপরাধের রহস্য উদ্‌ঘাটন করেছে এবং অপরাধ প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে।