তাসলিমার ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব কে নেবে, তা নিয়েই এখন চিন্তা

তাসলিমা বেগম। উত্তর-পূর্ব বাড্ডা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে ‘ছেলেধরা’ গুজব ছড়িয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাঁকে
ছবি: সংগৃহীত

মেয়ে তাসনিম মাহিরাকে (তুবা) স্কুলে ভর্তি করার জন্য খোঁজখবর নিতে গিয়েছিলেন তাসলিমা বেগম (রেণু)। ছেলেধরা গুজবে ওই মাকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছিল ২০১৯ সালের ২০ জুলাই। সেই তুবা এখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। মা মারা যাওয়ার পর সে ভেবেছিল, মা তার জন্য চিপস আনতে গেছেন। এখন একটু একটু বুঝতে পারে, মা আর হয়তো কোনো দিনই ফিরবেন না। সাত বছর দুই মাস বয়সী তুবা মায়ের মৃত্যুর পুরো ঘটনা এখনো বুঝতে পারে না।

তাসলিমা বেগম যখন মারা যান, তখন তাঁর ৯ বছর বয়সী ছেলে তাহসিন আল মাহির বুঝত তার মা আর ফিরবেন না। এখন এই ছেলে রাজধানীর উত্তরার একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। স্কুলের হোস্টেলেই থাকছে। আর তুবা মহাখালীতে তাসলিমা বেগমের বড় বোন নাজমুন নাহারের বাসায় থাকছে। এই নাজমুন নাহারকেই তুবা মা ডাকে।

তাসলিমা বেগমের এক ভাই ও চার বোন তুবা ও মাহিরের খরচ দিচ্ছেন। দুই ছেলেমেয়ের শুধু স্কুলের বেতন ও হোস্টেলের খরচেই লেগে যাচ্ছে ১৫ হাজার টাকা, অন্যান্য খরচ তো আছেই। তাই তাসলিমা বেগমের পরিবারের সদস্যরা এই দুই ছেলেমেয়ের খরচ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ছেন। পরিবারের সদস্যরা চান, রাষ্ট্র তাসলিমা বেগমের ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব নিক।

চলতি বছরের ঈদুল ফিতরের কয়েক দিন আগে তাসলিমা বেগমের মা সবুরা খাতুন মারা গেছেন। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে মায়ের দেখাশোনা করার জন্য তাসলিমা মহাখালীতে মায়ের সঙ্গেই থাকতেন। মা সবুরা খাতুন মৃত্যুর আগে মেয়ে হত্যার বিচার দেখে যেতে চেয়েছিলেন, তা তিনি দেখে যেতে পারেননি।

ছেলেধরা সন্দেহে রাজধানীর উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে গণপিটুনিতে প্রাণ হারান তাসলিমা বেগম। তাঁর স্বজনেরা জানালেন, এখন পর্যন্ত ওই স্কুল কর্তৃপক্ষ এ ঘটনার জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়নি। তাসলিমা মারা যাওয়ার পর তুবা ও মাহিরের কোনো খরচ দিচ্ছেন না তাদের বাবাও।

তাসলিমা বেগমের মৃত্যুর পর তাঁর ভাগনে সৈয়দ নাসির উদ্দিন বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় হত্যা মামলা করেন। তখন তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘মানুষ কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে, এ ঘটনা তার প্রমাণ। খালার একটি আঙুল নড়ছে, মানুষ সেই আঙুলে পেটাচ্ছে, আবার পা নড়ছে, সেখানে মারছে। সাপ বা অন্য কোনো প্রাণীকেও কেউ এভাবে মারতে পারে না। মানুষ যখন বুঝতে পেরেছে খালার কোনো অঙ্গ আর কাজ করছে না, তখন তারা মার থামিয়েছে।’

গতকাল বৃহস্পতিবার কথা হয় সৈয়দ নাসির উদ্দিনের সঙ্গে। জানালেন, তাসলিমা বেগমের ছেলে মন খারাপ করে থাকে। কান্নাকাটি করে। হোস্টেলে বন্ধুদের সঙ্গে যদি ভালো থাকে, সেই চিন্তা করে তাকে হোস্টেলে রাখা হয়েছে। আর মেয়ে মায়ের কথা তেমন মনে করতে পারে না। মায়ের ছবি নিয়ে সে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়। কেউ মায়ের প্রসঙ্গ তুললে মন খারাপ করে।

সৈয়দ নাসির উদ্দিন জানান, তাসলিমা বেগমের এক ভাই যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। তিনি অসুস্থ। মাঝেমধ্যে তাসলিমা বেগমের দুই ছেলেমেয়ের জন্য টাকা পাঠান। তাসলিমা বেগমের বোনদের সংসার আছে, তাঁদের বয়সও হয়েছে। তাই পরিবারের এই সদস্যদের অবর্তমানে তাসলিমা বেগমের দুই ছেলেমেয়ের দায়িত্ব কে নেবে, খরচ কে দেবে, তা–ই এখন চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আরও পড়ুন

তাসলিমা বেগম ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেছিলেন। পরে তিনি সরকারি তিতুমীর কলেজে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর করেন। তাসলিমা পড়াশোনা শেষে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। তবে পরে আর চাকরি করেননি।

নাসির উদ্দিন বললেন, ‘একজন মানুষ মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করতে গিয়ে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মারা যাবেন, এটা তো হতে পারে না। এর দায় তো রাষ্ট্রকে নিতেই হবে। তাই তাসলিমা বেগমের দুই ছেলেমেয়ের দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই নেওয়া উচিত।’

উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাসলিমা মেয়েকে ভর্তি করানোর বিষয়ে খোঁজ নিতে গেলে সেখানে উপস্থিত কয়েকজন নারী তাঁকে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহ করেন। এই গুজব দ্রুত বাইরে ছড়িয়ে পড়েছিল। আশপাশ থেকে বিভিন্ন বয়সী কয়েক শ নারী-পুরুষ স্কুল প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়েন। তাঁদের কবল থেকে রক্ষা করতে তাসলিমাকে স্কুলের দোতলায় প্রধান শিক্ষকের কক্ষে নিয়ে রাখা হয়। এর মধ্যে কয়েকজন বিদ্যালয়ের কলাপসিবল গেট ভেঙে দোতলায় প্রধান শিক্ষকের কক্ষ থেকে তাসলিমাকে টেনেহিঁচড়ে নিচে নামিয়ে পেটাতে শুরু করেন। প্রায় আধা ঘণ্টা নির্যাতনের পর মারা যান তাসলিমা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তখন এ ঘটনা ভাইরাল হয়। ঘটনার পর সৈয়দ নাসির উদ্দিন অজ্ঞাতনামা ৪০০-৫০০ ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করেন।

হত্যাকাণ্ডের প্রায় এক বছর পর ১৫ জনকে আসামি করে আদালতে তাসলিমা বেগম হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। মামলায় সাক্ষী মোট ৩২ জন। বিচারাধীন মামলায় এখন পর্যন্ত শিশুসহ (আসামিদের মধ্যে দুজন অপ্রাপ্তবয়স্ক) ২২ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে বলে জানালেন সৈয়দ নাসির উদ্দিন।

নাসির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুধু আমার খালা গণপিটুনিতে মারা গেছেন তা–ই নয়, এরপরও গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। খালার মামলাটির দ্রুত সুষ্ঠু বিচার হলে মানুষ বুঝতে পারত, এ ধরনের ঘটনা ঘটালে শাস্তি কী হতে পারে। আমরা সুষ্ঠু বিচার চাই। অপরাধীদের কঠোর শাস্তি চাই।’

আরও পড়ুন