চাঁদনী চক মার্কেটে নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে হামলার শিকার ঢাবি শিক্ষার্থীরা
রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার চাঁদনী চক মার্কেটের একটি দোকানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী মারধরের শিকার হয়েছেন। তাঁদের মারধর করে আটকে রাখা হয়। পরে শিক্ষার্থীরা গিয়ে সেখান থেকে তাঁদের উদ্ধার করেন। এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে নিউমার্কেট থানা–পুলিশ।
সোমবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে চাঁদনী চক মার্কেটের ‘জেসমিন ফেব্রিকস’ নামের একটি দোকানে এমন ঘটনা ঘটে। এতে আহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩-২৪ সেশনের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ শাহেদুল ইসলাম ও আয়াজুর রহমান।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী ফারহান জানান, দোকানে কাপড় কিনতে যাওয়ার পর এক পর্যায়ে কাপড়ের দাম নিয়ে আলোচনা চলাকালে দোকানকর্মীদের একজন ওই নারী শিক্ষার্থীর উদ্দেশে অরুচিকর মন্তব্য করে তাঁকে হেনস্তা করেন।
এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে ফারহান তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু শাহেদ ও রূপককে ফোন করে ঘটনাস্থলে ডাকেন। তাঁরা ওই নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্তার প্রতিবাদ করলে সেখানকার দোকানের ১০ থেকে ১২ জনের একটি দল তাঁদের মারধর শুরু করেন। দোকানের ব্যবস্থাপক ও আশপাশের দোকানিরা মিলে শিক্ষার্থীদের ‘চোর’ আখ্যা দিয়ে চিৎকার করতে থাকেন এবং একপর্যায়ে তাঁদের ওপর হামলা চালানো হয়।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী সাদমান শাহরিয়ার এক ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘গতকাল রাত আমার জীবনের অন্যতম ভয়াল একটি রাত ছিল। এক দুঃস্বপ্নের মতো। প্রতিদিনের মতো হাকিম চত্বরের রাজনৈতিক আড্ডায় মশগুল ছিলাম। এমন সময় বন্ধু সাকিবের নম্বরে কল আসে। আমাদের বন্ধু জার্নালিজম বিভাগের শাহেদ এবং সমাজকল্যাণের আয়াজকে নিউমার্কেটের কতিপয় ব্যবসায়ীরা মারধর করে আটকে রেখেছে। আমরা তৎক্ষণাৎ দুটি বাইক নিয়ে আগাই। যোগাযোগ করে জানতে পারি যে মার্কেটটি ঢাকা শহরের অন্যতম চাঁদনী চক মার্কেট। আমরা সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলে একজন লোক আমার দিকে এগিয়ে এসে বলে, আপনারা কি কাউকে নিতে আইছেন? আমরা হ্যাঁ বলার পর সে আমাদের তার সঙ্গে যেতে বলে। আমরা তার সাথে এগোই। আমরা তখনো জানি না এই লোকই আমার বন্ধু শাহেদকে অমানুষের মতো পিটিয়েছে। এরপর দোতলায় মিনিট দুই হেঁটে এক চিপাগলির মধ্যে অন্ধকার এক দোকানের মধ্যে শাহেদকে অবরুদ্ধ অবস্থায় আমরা দেখতে পাই।’
সাদমান শাহরিয়ার পোস্টে আরও বলেন, ‘আমরা লোকটিকে জিজ্ঞাসা করি, তার সাহস কীভাবে হলো যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীকে এভাবে মারধর করে আটকে রাখার। উপস্থিত ঢাবিয়ান বন্ধুরা তার ওপর চড়াও হয়। সে হাতে-পায়ে ধরতে থাকে। এর মধ্যে সেই মার্কেটের কর্মচারী সমিতির সাবেক সেক্রেটারি এবং প্রেসিডেন্টের সাথে যোগাযোগ করে আমাদের মার্কেটের মধ্যে গেট বন্ধ করে আটকে রাখে। এর মধ্যেই মার্কেটের বাইরে ঢাবির বিভিন্ন হলের ২৩-২৪ সেশনের শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে যান। এরপর তাঁরা সবাই মিলে গেট ভাঙার আপ্রাণ চেষ্টা করেও গেট ভাঙতে পারেননি। এরপর আমি ভেতর থেকে কাচের গ্লাস ভাঙতে গিয়ে আহত হই। এ ছাড়া আরও অনেকেই আহত হন মার্কেটের কর্মচারীদের সৃষ্টি করা মবের মাধ্যমে। যারা নির্দেশ দিয়েছিল, তারা হলো আওয়ামী দোসর মার্কেটের সেক্রেটারি নিজাম উদ্দিন এবং মনির হোসেন হাওলাদার। ১০-১২ জন ঢাবিয়ান অতর্কিত হামলায় বিহ্বল হয়ে পড়ে। এরপর গেট ভেঙে সবাইকে উদ্ধার করা হয়।’
এরপর মূল হামলাকারীকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয় জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘এরপর নিউমার্কেট থানায় দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টার অপেক্ষা। পুলিশ কলাবাগান ডিবি অফিসে আসামিকে নিয়ে যায়। ঢাকা কলেজ থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত আনতে পুলিশ দুই ঘণ্টা লাগিয়েছে। তাদের এত প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট দিয়ে কেন নিয়ে আসা হলো, আমার অবুঝ মন বারবার প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। এরপর মামলা নেওয়া হলো। মামলায় মার্কেটের সমিতির সেক্রেটারি-প্রেসিডেন্টের নাম যাতে না আসে সে জন্য বাইরে থেকে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের নানা প্রকার দর-কষাকষি চলেছে। ৫ আগস্টের পর আসামি ছাড়ানোর কালচার যে আমাদের আরেক ফ্যাসিজমের মুখোমুখি করছে, আমরা হয়তো সেটি ভুলে যাচ্ছি। আর সেটি করতে দেওয়া হয়নি আমার ২৩-২৪ সেশনের উপস্থিত সব বন্ধুর সহায়তায়। এরপর পুলিশ এজাহারভুক্ত আরও দুজন আসামিকে গ্রেপ্তার করে। তাদের ২৪ ঘণ্টা সময় দিয়ে আমরা থানা ত্যাগ করি। আমার ভাই শাহেদ আর আয়াজ হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতিবাদ
চাঁদনী চক মার্কেটে নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্তা এবং এর প্রতিবাদ করতে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রকে মারধরের ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। ভবিষ্যতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মঙ্গলবার উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান আহত শিক্ষার্থীদের দেখতে শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা মেডিকেল সেন্টারে যান। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম, সংশ্লিষ্ট হলের প্রাধ্যক্ষ ও সহকারী প্রক্টররাও উপস্থিত ছিলেন।
এ ঘটনায় পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে আরও ৫০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে নিউমার্কেট থানায় একটি মামলা করা হয়। পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে এবং বাকি অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে।