‘শ্রেষ্ঠ’ কাউন্সিলরের ওয়ার্ডে মাঠ, পাঠাগার নেই, রাস্তাঘাট বেহাল

মোহাম্মদ সেলিম

শিশু–কিশোরদের জন্য খেলার মাঠ নেই ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৪২ নম্বর ওয়ার্ডে। এই ওয়ার্ডে নেই কোনো সরকারি–বেসরকারি পাঠাগারও। বেশির ভাগ সড়ক সরু, ভাঙাচোরা ও অপরিচ্ছন্ন। ফুটপাতগুলো দখল হয়ে গেছে। যানজট যেন স্থানীয় মানুষের নিত্যসঙ্গী। বৃষ্টি হলে কিছু এলাকায় পানি জমে। নাগরিক সেবা এমন বেহাল হওয়ার পরও এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ সেলিম ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ‘শ্রেষ্ঠ’ কাউন্সিলরের স্বীকৃতি পেয়েছেন।

গত ২৬ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বোর্ড সভায় শ্রেষ্ঠ কাউন্সিলরের স্বীকৃতি দেওয়া হয় মোহাম্মদ সেলিমকে। স্বীকৃতির পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা, একটি ক্রেস্ট ও একটি সনদও দেওয়া হয় তাঁকে। গত অর্থবছরের (২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত) কাজের জন্য এই স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। ৪২ নম্বর ওয়ার্ডে প্রায় এক লাখ মানুষের বসবাস। এই ওয়ার্ডের সীমানার মধ্যে পড়েছে কুঞ্জু বাবু রোড, গোবিন্দ দত্ত লেন, রঘুনাথ দাস লেন, রোকনপুর লেন, পাঁচ ভাই ঘাট লেন, নাসির উদ্দিন সরদার লেন, কারকুনবাড়ি লেন, জনসন রোড, কাজী আবদুর রউফ রোড, নন্দলাল দত্ত লেন, নবদ্বীপ বসাক লেন, রাজচন্দ্র মুন্সী লেন, সুভাষ বোস অ্যাভিনিউ (লক্ষ্মীবাজার) এবং হাজি মজিদ লেন। এই ওয়ার্ডের মধ্যে বেসরকারি ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজসহ বেশ কিছু সরকারি–বেসরকারি স্থাপনা রয়েছে। অবশ্য দুটি বড় কলেজে খেলার মাঠ থাকলেও তা এলাকার শিশু–কিশোরেরা ব্যবহার করতে পারে না।

এই ওয়ার্ডের অধীন রায় সাহেববাজার পঞ্চায়েতের সাধারণ সম্পাদক সাইজউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘খোঁড়াখুঁড়ির কারণে চার মাস ধরে রাস্তাঘাটের ভয়ংকর অবস্থা। অলিগলির রাস্তার অবস্থা আরও খারাপ। নাসির উদ্দিন সরদার লেনে তো বৃষ্টি হলে মসজিদে পানি ঢুকে যায়।’

স্থানীয় লোকজন জানান, ওয়ার্ডে একটি কমিউনিটি সেন্টার থাকলেও সংস্কারের অভাবে তা ব্যবহারের অনুপযোগী। বেশির ভাগ সড়কে আবর্জনা পড়ে থাকে। ধোলাইখাল ও লক্ষ্মীবাজার এলাকার মূল সড়কের দুই পাশসহ ফুটপাতে দোকানিরা (বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ বিক্রির দোকান) পণ্য রাখেন। বছরের পর বছর এ অবস্থা চলে আসছে। ধোলাইখালের নাসির উদ্দিন সরদার লেন এলাকায় সরকারি জমি দখল করে স্থানীয় কিছু লোক মার্কেট (টং মার্কেট নামে পরিচিত) করেছেন। সেখানে অন্তত ৭০০ দোকান রয়েছে।

৪২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ম্যানহোলের ভেতর দিয়ে ওয়াসার পানির লাইনের পাইপ দেওয়া হয়েছে।

এভাবে যাতে কাজ না হয়, তা ওয়াসাকে জানাতে কাউন্সিলরকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু কাউন্সিলর বিষয়টি আমলে নেননি। তিনি বলেন, এলাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা খুব খারাপ, এভাবে চলা যায় না। কিছু রাস্তা এত সরু যে রিকশাও ঢুকতে পারে না। মানুষ সমস্যায় থাকলেও কাউন্সিলর কিছুই করছেন না।

কোন বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ কাউন্সিলর নির্বাচন করা হয়, তা জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, গৃহকর আদায়ে ভূমিকা, মশক নিয়ন্ত্রণ, কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণ, কত বছর ধরে কাউন্সিলরের দায়িত্বে—এ ধরনের বিষয় বিবেচনায় থাকে।

টানা তিন মেয়াদে ৪২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর দায়িত্ব পালন করছেন মোহাম্মদ সেলিম। প্রথমবার যখন কাউন্সিলর নির্বাচিত হন, তখন তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অবশ্য দলীয় কোনো পদে ছিলেন না। ঢাকার সাবেক মেয়র প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সরকার পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ততা বাড়ে তাঁর। অবশ্য দলীয় কোনো পদে নেই তিনি। সিটি করপোরেশনের সবশেষ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ–সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন।

স্থানীয় বাসিন্দাদের করা বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে কাউন্সিলর মোহাম্মদ সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, ওয়াসার পাইপলাইন করার কারণে সড়কগুলোর অবস্থা খারাপ। ডিসেম্বর নাগাদ সড়ক সচল করা হবে। ফুটপাত দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নিলে কাজ হয় না। ম্যানহোলের ভেতর দিয়ে পানির পাইপ দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না বলেও তিনি জানান তিনি। তাঁর দাবি, সততা, নিষ্ঠা ও জনপ্রিয়তার কারণেই শ্রেষ্ঠ কাউন্সিলরের স্বীকৃতি পেয়েছেন।

চলতি আগস্ট মাসের ৬ ও ১২ আগস্ট—এই দুই দিনে পুরো ৪২ নম্বর ওয়ার্ড ঘুরে দেখেছেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। কথা হয় বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার ২০ জন বাসিন্দার সঙ্গে। তাঁরা বলেছেন, বিভিন্ন সড়কে ম্যানহোলের ঢাকনা নেই। বেশির ভাগ নালা-নর্দমা উন্মুক্ত থাকায় দুর্গন্ধ ছড়ায়। রাস্তাঘাটের যা অবস্থা, তাতে এলাকায় কাউন্সিলর আছে বলে মনে হয় না।

নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, ময়লা–আবর্জনা পরিষ্কার, মশকনিধন ও নিরাপত্তার সঙ্গে নাগরিকদের চলাচল নিশ্চিত করা—এই তিন বিষয়ে কাজ করতে ব্যর্থ হওয়ার পরও যদি কাউকে পুরস্কৃত করা হয়, তাহলে বলতে হবে জনদুর্ভোগ লাঘবে সিটি করপোরেশনের আসলে মনোযোগ নেই। এলাকার প্রকৃত অবস্থা বিবেচনায় না নিয়ে কোনো কাউন্সিলরকে পুরস্কৃত করার অর্থ হচ্ছে—মানুষ কী ভাবছে, তা সিটি করপোরেশনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়।