বাবার সঙ্গে ঘুমিয়ে থাকা শিশু সুরাইয়ার এমন মৃত্যু কেউ মানতে পারছে না

জালাল উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে তাঁর মেয়ে সুরাইয়া আহমেদ। ছবিতে থাকা সুরাইয়া এখন কেবলই স্মৃতিছবি: সংগৃহীত

বাবা জালাল উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে ঘুমিয়েছিল ১০ বছর বয়সী সুরাইয়া আহমেদ। ঘুম থেকে আর জাগতে পারেনি শিশুটি।

রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকায় সুরাইয়াদের টিনশেড বাসা। পাশে একটি নির্মাণাধীন বহুতল ভবন। ২৭ মে সকালে পৌনে ৭টার দিকে ভবনটির ১১ তলার দেয়ালের একটি অংশ ধসে সুরাইয়াদের ঘরের টিনের চালার ওপরে পড়ে। টিনের চালা ভেঙে এসব ভারী বস্তু পড়ে ঘুমন্ত সুরাইয়ার মাথায়।

সুরাইয়ার মাথা ফেটে যায়। সে অচেতন হয়ে পড়ে। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। রাখা হয় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। সেখানেও তার জ্ঞান ফেরেনি। চিকিৎসকেরা ‘লাইফ সাপোর্ট’ খুলে দিলে গত বুধবার সুরাইয়ার মৃত্যু হয়।

ভুক্তভোগী পরিবারটি জানায়, নির্মাণাধীন ভবনের দেয়ালের ইট-সুরকির পাশাপাশি নিজেদের ঘরের ফ্যানও সুরাইয়ার মাথায় পড়েছিল। এগুলোর কিছু অংশ পড়েছিল সুরাইয়ার বাবা জালাল উদ্দিন আহমেদের (৫০) মুখে। এতে তাঁর চারটি দাঁত পড়ে গেছে। দুই চোয়াল ও নাক ভেঙে গেছে।

ঘটনার পরপরই বাবা-মেয়েকে উত্তরার কেসি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে সুরাইয়াকে আগারগাঁওয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়।

আর জালালকে কেসি হাসপাতাল থেকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে তাঁর নাকে অস্ত্রোপচার করা হয়। পরে তাঁকে মিরপুরের ঢাকা ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

সুরাইয়া পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত। তার মৃত্যুর খবর প্রথমে বাবা জালালকে জানানো হয়নি। স্বজনেরা বলেছিলেন, তাঁকে হাসপাতাল থেকে দুই দিনের জন্য ছুটি দিয়েছেন চিকিৎসকেরা।

হাসপাতাল থেকে ফিরে বাড়িতে ঢোকার আগে বাড়িভর্তি লোকজন দেখতে পান জালাল। তাঁর বুঝতে বাকি থাকে না, মেয়ে আর বেঁচে নেই।

দক্ষিণখানেই সুরাইয়ার দাফন হয়। পরে জালাল আবার ঢাকা ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতালে ফেরেন। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে হাসপাতালে থাকা জালালের সঙ্গে মুঠোফোনে অল্প সময়ের জন্য কথা হয় এই প্রতিবেদকের। দাঁত পড়ে যাওয়াসহ তীব্র ব্যথার কারণে তিনি স্পষ্ট করে কথা বলতে পারছিলেন না।

মেয়ের মৃত্যু কোনোভাবেই মানতে পারছেন না জালাল। একটু দম নিয়ে তিনি বলেন, মেয়েকে তো আর ফিরে পাবেন না। কিন্তু তিনি চান না, আর কোনো মা–বাবার বুক এভাবে খালি হোক। ভবন নির্মাণে যাঁরা অবহেলা করেছেন, তাঁদের কঠোর শাস্তি দাবি করেছেন তিনি।

সুরাইয়ার এক বোন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। মা ফিরোজা হক মেয়ে হারানোর শোকে কাতর। তিনি বলেন, সেদিন একই বিছানায় তিনিও ঘুমাচ্ছিলেন। তিনি সেভাবে আহত হননি। তবে মেয়েটা তো চলে গেল।

সেদিনের কথা বলতে গিয়ে ফিরোজা বলেন, বৃষ্টির কারণে মেয়েরা স্কুলে যাবে না বলে ঠিক হয়। ওই ঘরে তিনি, তাঁর স্বামী ও মেয়ে সুরাইয়া ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পান। শুধু দেখতে পান সুরাইয়া রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মেয়েটা ঘুমে ছিল। অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হলো। তার জ্ঞান আর ফিরল না। তারপর সব শেষ হয়ে গেল।

জালাল দৈনিক সমকালের মার্কেটিং বিভাগে জ্যেষ্ঠ নির্বাহী হিসেবে কর্মরত। তাঁরা পাঁচ ভাই দক্ষিণখানের কাজীবাড়ি রোডের একটি বাসায় একসঙ্গে থাকেন।

ঘটনার পর ২৮ মে জালালের বড় ভাই সাইফুদ্দিন আহমেদ দক্ষিণখান থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় চারজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁরা হলেন আনিছ, মোর্শেদ, জসিম উদ্দিন ও মমিন। মামলায় তাঁদের ভবনের মালিক কাম ঠিকাদার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া মামলায় ৪০-৪২ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।

মামলায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ভবন নির্মাণ নির্দেশনা না মেনে, অবহেলা করে ১৪ তলা ভবন নির্মাণের (নির্মাণাধীন) অভিযোগ আনা হয়। মামলায় ঘর ভেঙে আনুমানিক ১২ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

দক্ষিণখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ আমিনুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার তদন্ত চলছে। আসামিরা পলাতক। আসামিদের ধরার চেষ্টা চলছে।

গতকাল সাইফুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ভবনটি নির্মাণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি যাতে মেনে চলা হয়, সে জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বলা হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা কথা শোনেননি। এখন ভবনটির ১১ তলার দেয়াল ধসের ঘটনায় তাঁর ভাই (জালাল) মেয়ে হারালেন। গুরুতর আহত হওয়া জালাল কবে সুস্থ হবেন, তা তাঁরা জানেন না। নির্মাণাধীন ভবনসংশ্লিষ্ট ঝুঁকি এখনো আছে। তাই তাঁরা ভয়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।

ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে সাইফুদ্দিন বলেন, সাতসকালে তিনি বিকট শব্দ শুনে ভাইয়ের ঘরে দৌড়ে যান। গিয়ে দেখেন, সুরাইয়ার মাথা ফেটে রক্তের বন্যা বইছে। ভাইয়ের অবস্থাও খারাপ। দ্রুত এই দুজনকে হাসপাতালে নিয়ে যান। তারপর এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে দৌড়ান তাঁরা। টাকাপয়সা যা লাগে, খরচ করেছেন। কিন্তু ভাইয়ের মেয়েকে বাঁচাতে পারেননি।

নিজেদের বাড়িতে কেন ভাই (জালাল) ও তাঁর মেয়ে নিরাপদ থাকতে পারল না, কেন ছোট মেয়েটি (সুরাইয়া) ঘুম থেকে আর উঠতে পারল না, সেই প্রশ্ন ক্ষোভের সঙ্গে রাখেন সাইফুদ্দিন।

রাজউকের মুখপাত্র নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নির্মাণাধীন ভবনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নিরাপত্তার বিষয়ে অবহেলা করেছেন। এখানে নিয়মের ব্যত্যয় হয়েছে।

ভবন নির্মাণে নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়গুলো মেনে চলার ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে বলে উল্লেখ করেন আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠিত আবাসন নির্মাণ কোম্পানিগুলো ছাড়া অন্যদের তা তেমন একটা মানতে দেখা যায় না। যে নির্মাণাধীন ভবনটির বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেখানেও নিয়ম মানা হয়নি। ভবনটির চারদিকে জাল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়নি। তা ছাড়া ভুক্তভোগী পরিবারটি নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকবার সতর্ক করেছিল বলে জানা যাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় রিমালের খবর তো আগে থেকেই জানা ছিল। তাই তখন নির্মাণকাজ বন্ধ রাখা উচিত ছিল। কিন্তু তা বন্ধ রাখা হয়নি। এই ঘটনায় ইমারত নির্মাণ আইন অনুযায়ী অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে রাজউক।

ইমারত নির্মাণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিতে রাজউক বিভিন্ন সময় মাইকিং করে, লিফলেট বিতরণ করে বলে জানায় সংস্থাটি। তবে তারপরও রাজধানীতে থেমে নেই এ-সংক্রান্ত দুর্ঘটনা। হয় নির্মাণশ্রমিকের মৃত্যু ঘটছে, নয়তো নির্মাণাধীন ভবন থেকে ইটসহ ভারী বস্তু নিচে পড়ে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম জানালেন, এসব বিষয় তদারকির জন্য রাজউকের বিভিন্ন জোনে মাত্র ২০০ জনের মতো ইমারত পরিদর্শক আছেন। এই জনবল দিয়ে ভবন তদারকির কাজ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে করা রাজউকের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। তাই তৃতীয় পক্ষ (থার্ড পার্টি) নিয়োগের মাধ্যমে এই তদারকি কাজ পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছে রাজউক। এ জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে বিষয়টি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

মারা যাওয়া শিশু সুরাইয়ার মা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ঘটনার (মেয়ের মৃত্যু) অবশ্যই বিচার চাই। তবে আমার যে ক্ষতি হলো, তা তো আর কোনোভাবেই পূরণ হবে না।’