সংস্কারের পর দৃষ্টিনন্দন রূপে ঢাকা গেট

সংস্কারকাজ শেষে ঢাকা গেটের নতুন রূপছবি: তানভীর আহাম্মেদ

অযত্ন আর অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসা ঢাকা গেট (ফটক) সংস্কার করে পুরোনো আদলে আনার চেষ্টা করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। প্রায় আট মাস ধরে সংস্কারের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বরের পাশে ঐতিহাসিক এই গেট আজ বুধবার বিকেলে খুলে দেওয়া হয়েছে। কাজ শেষে দৃষ্টিনন্দন রূপে ফিরেছে স্থাপনাটি।

এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ঢাকা কোষে বলা হয়েছে, মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে বাংলার সুবেদার মির জুমলা ১৬৬০ থেকে ১৬৬৩ সালের মধ্যে ঢাকার সীমানা চিহ্নিত করতে এবং স্থলপথে শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে এটি নির্মাণ করেছিলেন।

আজ বিকেলে এক অনুষ্ঠানে সংস্কার করা ঢাকা গেটের উদ্বোধন করেন ডিএসসিসির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। গেটের একটি অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবায়নযোগ্য শক্তি গবেষণা কেন্দ্রের দিকে, মাঝখানের অংশটি সড়ক বিভাজকের ওপর এবং অন্য অংশটি পড়েছে তিন নেতার মাজারের পাশে। মির জুমলার আসাম অভিযানের ‘বিবি মরিয়ম’ নামের কামানটি ওসমানী উদ্যান থেকে এনে ঢাকা গেটের শক্তি গবেষণা কেন্দ্র অংশে স্থাপন করা হয়েছে। গেটের আশপাশে দর্শনার্থীদের জন্য বসার জায়গা রাখা হয়েছে। পাশাপাশি আছে আলোকসজ্জার ব্যবস্থাও।

সংস্কার করা ঢাকা গেটের উদ্বোধন করেন ডিএসসিসির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। ঢাকা, ২৪ জানুয়ারি
ছবি: প্রথম আলো

অনুষ্ঠানে শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘মোগল আমলের ঢাকা গেটকে আমরা আবার পুনরুজ্জীবিত করতে পারলাম, সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে পারলাম। এটা ঢাকা দক্ষিণ সিটির জন্য একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত।...নজরের বাইরে চলে যাওয়া বিষয়গুলো আমরা পুনরুজ্জীবিত করছি। আমি আজ খুবই আনন্দিত। আমার প্রথম সন্তান যেদিন জন্মগ্রহণ করেছে, সেদিন যে রকম আনন্দিত হয়েছিলাম, আজ আমার সে রকম আনন্দ হচ্ছে। এটা একটা উন্মুক্ত জাদুঘর।’ কেউ সংস্কার করা ঢাকা গেটের পরিবেশ নষ্ট করলে তাঁকে জরিমানাসহ কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে বলে তিনি সতর্ক করেন।

ঢাকাকে পূর্ণ চরিত্রে ফিরিয়ে আনতে হলে এই শহরের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে হবে উল্লেখ করে মেয়র তাপস বলেন, ‘খুবই অল্প অর্থে ঢাকা গেটের সংস্কার করা হয়েছে। কোনো বড় বরাদ্দের প্রয়োজন হয়নি, প্রয়োজন হয়েছে ঐতিহ্যের প্রতি ভালোবাসা ও আন্তরিকতা। আরও ৪০০ বছর পরও এটা জীবিত ও অম্লান থাকবে। আমরা অনেক দেশে অনেক কিছু দেখি। যেমন দুবাইয়ে বড় বড় অট্টালিকা, বড় সড়ক ও অবকাঠামো আছে। এগুলো নতুন। অনেক নতুন কিছু করতে পারবে, কিন্তু কয়েক শ বছরের পুরোনো ঢাকা গেট ও কামান দুবাইয়েও পাওয়া যাবে না।’

মির জুমলার আসাম অভিযানের ‘বিবি মরিয়ম’ নামের কামানটি ঢাকা গেটের সামনে স্থাপন করা হয়েছে
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের অধ্যাপক আবু সাঈদ এম আহমেদ সংস্কার দলের নেতৃত্ব দেন। সংস্কারের কাজে চুন, সুপারির কষ, চিটা গুড়, ইটের গুঁড়া, খয়ের ও মধ্যপাড়ার গ্রানাইট পাথরকুচি ব্যবহার করা হয়েছে। গেটটি সংস্কারে খরচ হয়েছে প্রায় ৮২ লাখ টাকা।

ঢাকার ঐতিহ্য রক্ষায় ডিএসসিসির নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরে মেয়র বলেন, ‘আমরা লালকুঠি সংস্কারের কাজ হাতে নিয়েছি। বিআইডব্লিউটিএকে লালকুঠির সামনে থেকে লঞ্চঘাটের পন্টুন সরিয়ে নিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। নদী থেকে যাতে শহর, লালকুঠি, আহসান মঞ্জিল দেখা যায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। জুনের মধ্যেই সংস্কার সম্পন্ন করে লালকুঠি উন্মুক্ত করতে পারব বলে আমরা আশাবাদী।’

সংস্কার করা ঢাকা গেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেন অনেকে। ঢাকা, ২৪ জানুয়ারি
ছবি: প্রথম আলো

অনুষ্ঠানে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘আমরা অনেকেই ১৯৭২ সাল থেকে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে ঢাকার ঐতিহ্য রক্ষার কথা বলে এসেছি। যখন মির্জা আব্বাস মেয়র ছিলেন, তখনই আমি চেষ্টা-তদবির শুরু করেছিলাম। তখন নষ্ট হতে বসা অমূল্য সম্পদ পুরোনো নথিপত্রগুলো তাঁকে ও পরবর্তী মেয়রকে বুঝিয়েসুঝিয়ে আর্কাইভসে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম। ঢাকা সিটি করপোরেশন সম্পর্কে গবেষণা করতে হলে এখন আর্কাইভসে যেতে হবে।’

মোগল ঐতিহ্য স্মরণ করিয়ে দিতে হাতি নিয়ে এসেছিলেন মাহুত। ঢাকা, ২৪ জানুয়ারি
ছবি: প্রথম আলো

মুনতাসীর মামুন আরও বলেন, ‘বর্তমান মেয়রকে অনুরোধ করব, কমপক্ষে দুটি কক্ষে আপনাদের নথিপত্রগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করুন, যেখানে গবেষকেরা এসে গবেষণা করতে পারবেন। নগর আর্কাইভসের পত্তন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমরা আপনাকে সম্পূর্ণ সহায়তা করব।’

ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ঢাকা গেট সংস্কারের কাজটি দ্রুত সম্পন্ন করায় ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়রকে অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, ঢাকায় আরও অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আছে। এ ধরনের কাজ ভবিষ্যতে আমাদের আরও করে যেতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, অন্য নিদর্শনগুলো রক্ষায়ও মেয়র কাজ করবেন।’

ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। এ সময় বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মাকসুদুর রহমান।