বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মা, বাবা ও বোন মারা গেছে। বেঁচে গেছে শিশু হোসাইন। তাকে কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন প্রতিবেশী আমেনা। গতকাল রাজধানীর মিরপুর ২ নম্বর ঝিলপাড় বস্তিতে
ছবি: জাহিদুল করিম

দুই সপ্তাহ গ্রামে কাটিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় ফেরেন মিজান হাওলাদার (৩৫) ও তাঁর স্ত্রী মুক্তা (২৫)। মিরপুরে কমার্স কলেজ–সংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তিতে থাকতেন তাঁরা। বাসায় ফিরে দুপুরে সবাইকে নিয়ে গিয়েছিলেন চিড়িয়াখানা এলাকায় শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে দেখা করতে। ওই দিন রাজধানীতে থেমে থেমে দিনভর বৃষ্টি হয়েছে। সন্ধ্যার পর তা বেড়ে সড়কে পানি জমে যায়। সেই বৃষ্টিতে ভিজেই বাসায় ফিরছিলেন মিজান।

বাসার কাছাকাছি এসে মিজান, তাঁর স্ত্রী মুক্তা ও মেয়ে লিমা (৭) বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যান। আহত হলেও বেঁচে আছে মিজান-মুক্তা দম্পতির সাত মাসের ছেলে হোসাইন। মিজানের পরিবারের সদস্যদের উদ্ধার করতে গিয়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা গেছেন একই এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ অনিক (১৮)। এ ঘটনায় অনিকের বাবা বাবুল মিয়া বাদী হয়ে মিরপুর থানায় মামলা করেছেন। মামলায় ঝুঁকিপূর্ণভাবে বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়ার কারণে এ ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করা হয়।

মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহসীন গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, ঘটনাস্থলে তাঁরা কীভাবে বিদ্যুতায়িত হয়েছেন, তা তদন্ত করে দেখছি। মামলায় ঝুঁকিপূর্ণভাবে বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়ার কারণে এ ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। সুনির্দিষ্টভাবে অবহেলাটি কার, তা দেখা হচ্ছে।’

জানতে চাইলে ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির (ডেসকো) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমির কাউসার আলী প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘ফায়ার সার্ভিস থেকে বিষয়টি জানানো হলে আমাদের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়া বা অবৈধ সংযোগের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।’

তবে এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। গতকাল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মীর মোহাম্মদ আসলাম উদ্দিনের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘গ্রাহকের ইন্টারনাল সার্ভিসের ওয়্যারিং ত্রুটির কারণে বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক। তদন্তপূর্বক পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।’

অবশ্য পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ জসীম উদ্দীন মোল্লা বৃহস্পতিবার রাতে বলেছিলেন, বৃষ্টির সময় বজ্রপাত হলে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পানিতে পড়ে। এতে পাঁচজন বিদ্যুতায়িত হন।

নিহত মিজানের গ্রামের বাড়ি বরিশালে। তিনি ঢাকায় শরবত, ঝালমুড়ি ইত্যাদি বিক্রি করে সংসার চালাতেন। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে থাকতেন ঝিলপাড় বস্তিতে। গতকাল শুক্রবার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে গিয়ে কথা হয় মিজানের বাবা নাসির হাওলাদারের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সকালেই মিজান পরিবারসহ বরিশাল থেকে লঞ্চে করে ঢাকায় ফেরে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ছেলেকে ফোন করি। মিজান বলল, বাবা, ভালোভাবে বাসায় এসেছি। রাতে ঘুমাতে যাব, তখন ফোন আসে যে ওরা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছে।’

যেভাবে বেঁচে গেল শিশুটি

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্র জানায়, মিরপুর কমার্স কলেজসংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তির কাছে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে রাস্তায় পড়েছিল। সেই রাস্তা দিয়েই রাত সাড়ে নয়টার দিকে দুই সন্তান ও স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন মিজান। তখন সাত মাসের শিশু হোসাইন ছিল বাবার কাঁধে। বিদ্যুতায়িত হওয়ার পর মিজান তাঁর ছেলেকে বাঁচাতে দূরে ছুড়ে মারেন। পানিতে ভাসতে থাকেন সবাই। তখন পাশের একটি দোকানে বসে ছিলেন অনিক। শিশুটিকে বাঁচাতে অনিক ছুটে যান। হোসাইনকে পানি থেকে তুলে একজনের কাছে রেখে তাঁর বোন লিমাকে তুলতে যান। তখন বিদ্যুতায়িত হন অনিক।

পরে আহত হোসাইনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান হিজড়া আমিনা ও বৃষ্টি।

ঘটনা প্রসঙ্গে বৃষ্টি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা বৃষ্টির সময় বাসাতেই ছিলেন। একপর্যায়ে হইচই শুনে বের হয়ে শোনেন, কয়েকজন মারা গেছেন। তখন দেখতে পান, ছোট একটা বাচ্চা পানিতে ভাসছে। বাচ্চাটিকে একজন তুলে নিয়ে আসেন। আশপাশের নারীরা তাকে বাসায় নিয়ে তেল মাখিয়ে দেন। পরে বাচ্চাটির নাক দিয়ে রক্ত বের হলে হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু পরিচিত কেউ নেই, কে নিয়ে যাবে হাসপাতালে? এই দোটানা দেখে তিনি ও আমিনা বাচ্চাটিকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হন।

আশপাশের কয়েকটি হাসপাতালে ঘুরলেও কোথাও বাচ্চাটিকে ভর্তি করানো যায়নি উল্লেখ করে বৃষ্টি বলেন, পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে শিশুটিকে ভর্তি করানো হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে সকালে হোসাইনকে ছেড়ে দেন চিকিৎসকেরা। এখন শিশুটি তার নানির কাছে রয়েছে।

শিশুটির দাদা নাসির হাওলাদার বলেন, ‘এতটুকু বয়সেই নাতি এতিম হলো। ওর নানা-নানি ঢাকায় কাজ করেন। হোসাইনকে রাখার মতো অবস্থা তাঁদের নেই। আমি নাতিকে গ্রামে নিয়ে যাব।’

শুক্রবার বাড়ি ফেরার কথা ছিল অনিকের

ছেলে মারা যাওয়ার খবর পেয়ে নেত্রকোনা থেকে ঢাকায় ছুটে এসেছেন অনিকের বাবা বাবুল মিয়া। গতকাল সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে বাবুল মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আট ছেলে মেয়ের মধ্যে অনিক ছিল সবার ছোট। মারা যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেও তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। আজ (বৃহস্পতিবার) গ্রামের বাড়িতে ফেরার কথা ছিল ছেলের। কিন্তু ছেলে আমার চলে গেল।’

অনিকের মৃত্যুর খবর পেয়ে বাবুল মিয়ার সঙ্গে হাসপাতালে ছুটে আসেন পরিবারের সদস্যরা। তাঁরা বলেন, অনিক খুব ছোটবেলায় পালিয়ে ঢাকায় আসে। মিরপুর এলাকায় রিকশা চালাতেন। স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন ঝিলপাড় বস্তিতে। পারিবারিক কলহের জেরে দুই দিন আগে অনিককে ছেড়ে চলে যান তাঁর স্ত্রী।

পরিবারের সদস্যরা জানান, স্ত্রী চলে যাওয়ায় ভাড়া বাসা ছেড়ে রিকশার গ্যারেজে থাকতেন অনিক। শুক্রবার বাড়িতে মায়ের কাছে যাওয়ার কথা ছিল অনিকের। অনিক বাড়ি যাচ্ছেন ঠিকই, তবে লাশ হয়ে।