নিরাপত্তার অজুহাতে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত না করার আহ্বান

সংবাদ সম্মেলনে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন কমিটির নেতারা। আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারি-২-এছবি: প্রথম আলো

নিরাপত্তার অজুহাতে বাঙালির নববর্ষ পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত না করা এবং ঐতিহ্যবাহী মঙ্গল শোভাযাত্রায় পুলিশি প্রহরায় পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছেন নববর্ষ উদ্‌যাপন কমিটির নেতারা। আজ রোববার দুপুর ১২টায় এক সংবাদ সম্মেলনে এই আহ্বান জানানো হয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট রাত নয়টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান করবে বলে জানিয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারি-২–তে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন কমিটি এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। এতে নববর্ষ উদ্‌যাপন কমিটির নেতারাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের নেতারা অংশ নেন। বরাবরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে গঠিত নববর্ষ উদ্‌যাপন কমিটি ঐতিহ্যবাহী মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ তিন দিনের অনুষ্ঠান আয়োজন করে।

সংবাদ সম্মেলনে সূচনা বক্তব্যে উদ্‌যাপন কমিটির সদস্যসচিব চারুকলা অনুষদের ডিন শিল্পী অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, এবার পবিত্র ঈদুল ফিতর ও পয়লা বৈশাখ কাছাকাছি সময় পড়ায় সবাই লম্বা ছুটি পেয়েছেন। চারুকলার শিক্ষার্থীদের অনেকেই বাড়িতে চলে গেছেন। শোভাযাত্রাকে বর্ণাঢ্য করে তুলতে তাঁরাই নানা রকম উদ্যোগ নিয়ে থাকেন। ফলে প্রস্তুতিকাজে লোকবল কমে গেছে। সেই ঘাটতি পূরণ করতে প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকেরাও এবার প্রস্তুতির কাজে অংশ নিয়েছেন। এ ছাড়া উৎসবে নতুন মাত্রা যোগ করতে এবার সোনারগাঁ লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় কবিতা পরিষদ, জাতীয় প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন সহযোগী হিসেবে ভূমিকা রাখছে।

বরেণ্য শিল্পী ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুন নবী বলেন, এবার দুই আনন্দ উৎসব পরপর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ঢাকা থেকে অনেকই তাঁদের গ্রামের বাড়িতে যাবেন। এখন রাজধানীর বাইরে দেশজুড়েই আনন্দ উৎসবের সঙ্গে পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপিত হয়। ফলে এবার একটা অন্য রকম আমেজ আসবে উৎসবে। শিল্পী সাহিত্যিক সাংবাদিক সবাই মিলেই নববর্ষের উৎসব সফল করে তুলতে ভূমিকা রাখবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, নববর্ষ উদ্‌যাপন নিয়ে আন্তমন্ত্রণালয়ের সভাতেও তাঁরা বলেছেন, নিরাপত্তার কথা বলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের সময় সংকোচন করা ঠিক হবে না। এতে সাম্প্রদায়িক শক্তিই উৎসাহিত হবে। শঙ্কা থাকতে পারে, কিন্তু নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। তিনি আরও বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রার নিরাপত্তা দিতে গিয়ে পুলিশ ও সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীরা সামনে পেছনে ও দুই পাশে অবস্থান নিয়ে শোভাযাত্রা এমনভাবে ঘিরে রাখেন যে শোভাযাত্রার মূল সৌন্দর্যই নষ্ট হয়ে যায়। শোভাযাত্রার নান্দনিকতা রক্ষা করে নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছও বলেন, অন্য কোনো উৎসবে, অনুষ্ঠানে সময় বেঁধে দেওয়া হয় না। কিন্তু কয়েক বছর ধরে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানের সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একইভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রাতেও যেন লোকজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিতে পারে, শোভাযাত্রার সৌন্দর্য ক্ষুণ্ন না হয়, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি জানান, এবার সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিকেল চারটা থেকে নববর্ষের অনুষ্ঠান শুরু করবে। এই অনুষ্ঠান রাত নয়টা পর্যন্ত চলবে। অনুষ্ঠান বন্ধ না করে, প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দিতে পুলিশের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্তের বক্তব্যও ছিল একই রকম। তিনি বলেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনা এই উৎসব সীমিত না করে সবাই যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিতে পারে, মানুষের মনে যেন কোনো শঙ্কা না থাকে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।

উদ্‌যাপন কমিটির সভাপতির বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য (প্রশাসন) এবং জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি কবি মুহাম্মদ সামাদ বলেন, পয়লা বৈশাখের উৎসব দেশের সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক চেতনার উৎসব। নাগরিক সমাজ জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারের গৌরব উদ্‌যাপন করতে এই উৎসবে অংশ নিয়ে থাকে। এখন শুধু দেশে নয়, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাঙালিরা পয়লা বৈশাখের উৎসব উদ্‌যাপন করছে। বৈশাখী মেলা, মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ নানা রকম আয়োজনে ভেতর দিয়ে প্রবাসীরা নতুন প্রজন্মের কাছে বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরছেন। এই অনুষ্ঠানের সময় সীমিত করা কাম্য নয়।

কবি মুহাম্মদ সামাদ বলেন, এবার মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে ‘আমরা তো তিমির বিনাশী’।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন সোনারগাঁ লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরের পরিচালক আমিনুর রহমান সুলতান, জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কবি তারিক সুজাত, শিল্পী সৈয়দ আবুল বারক আলভী, গ্যালারি চিত্রকের পরিচালক শিল্পী মো. মুনিরুজ্জামান, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পুত্র ময়নুল আবেদিন প্রমুখ।

তিন দিনের আয়োজন
এবারের পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে তিন দিনের অনুষ্ঠান হবে। চারুকলার বকুলতলায় ১৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় হবে চৈত্রসংক্রান্তির অনুষ্ঠান।

‘আমরা তো তিমির বিনাশী’ প্রতিপাদ্য নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হবে পয়লা বৈশাখ সকাল নয়টায়। এবার শোভাযাত্রাটি শাহবাগ মোড় ঘুরে বারডেমের পাশ দিয়ে, শিশু একাডেমির সামনের মোড় ঘুরে আবার শাহবাগ দিয়ে টিএসসি হয়ে চারুকলার সামনে এসে শেষ হবে। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায় বড় আকারের প্রতীকগুলো তৈরি করা হয়েছে লোকসংস্কৃতির উপকরণ ও দেশের বিপন্ন প্রাণীদের নিয়ে। এর মধ্যে থাকবে একটি হাতি, বনরুই, গন্ধগোকুল, টেপাপুতুল, চাকা ইত্যাদি। এ ছাড়া থাকবে বড় আকারে রাজা-রানির দুটি মুখোশ। ছোট আকারে হাতে বহন করার মতো ফুল, প্যাঁচা, পাখির মুখোশ থাকবে শতাধিক।

তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় বকুলতলায় মঞ্চস্থ হবে বাংলার স্বাধীন সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের জীবনভিত্তিক যাত্রাপালা ‘গঙ্গা থেকে বুড়িগঙ্গা’। পালা লিখেছেন শান্তিরঞ্জন দে। নির্দেশনা দিয়েছেন সেতু খান। যাত্রাপালায় অভিনয় করবেন চারুকলার শিক্ষার্থীরা।