গ্যাসের ‘ওভারফ্লো’ থেকে গন্ধ ছড়িয়েছে, এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়: ইয়াসির আরাফাত খান

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইয়াসির আরাফাত খান। তিনি কারখানায় রাসায়নিক দুর্ঘটনা নিয়ে গবেষণা করেন। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে, রাজধানীর মগবাজারে, নারায়ণগঞ্জের মসজিদে, সায়েন্স ল্যাবের কাছের ভবনে এবং সর্বশেষ সিদ্দিকবাজারের ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন। ঢাকায় বিভিন্ন স্থানে গতকাল সোমবার রাতে যে গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল, এর কারণ এবং ঝুঁকির দিকগুলো নিয়ে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইয়াসির আরাফাত খান
ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: সোমবার রাতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এরপর এ ঘটনায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ব্যাখ্যা দেয় ঈদে শিল্পকারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনে গ্যাসের চাপ বেড়ে যাওয়ায় (ওভারফ্লো) গন্ধ বাইরে আসছে। এ যুক্তি কতটুকু গ্রহণযোগ্য?

ইয়াসির আরাফাত খান: দেখুন কোথাও গ্যাস সরবরাহ যেকোনো কারণে বিঘ্নিত হতে পারে, রক্ষণাবেক্ষণের কাজে কোনো লাইন বন্ধ রাখতে হতে পারে। কিন্তু তার জন্য অন্য বিতরণ লাইনে গ্যাসের চাপ বাড়ার কারণে বিশেষ করে আবাসিক এলাকায় গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। আবাসিক এলাকায় পুরোনো পাইপলাইনে লিকেজের (ছিদ্র) ঘটনা নতুন কিছু নয়। এর সঙ্গে যদি গ্যাসের চাপ বৃদ্ধি পায় তবে গ্যাস পাইপলাইনের লিকেজ থেকে নির্গত গ্যাসের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। তা ছাড়া পুরোনো ত্রুটিপূর্ণ পাইপলাইন, সেফটি রিলিফ ভালভ, রাইজার ও পাইপলাইনের সংযোগস্থল থেকে গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই বিতরণ লাইন ত্রুটিপূর্ণ না হলে এভাবে গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত না। আবাসিক এলাকায় এটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের সৌভাগ্য যে বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু এতে সমস্যার সমাধান হলো না। বলা যায়, গতকালের ঘটনার মধ্য দিয়ে অনেক দিনের পুরোনো সমস্যা নতুন করে প্রকাশ হলো। তিতাসের সঞ্চালন লাইনের ত্রুটির বিষয়টিকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। গতকালের বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় তা আবার সামনে এল।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: শিল্পকারখানায় গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ থাকায় চাপ বেড়েছে তাই ওভারফ্লো, বলছে মন্ত্রণালয়। এমন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা কি নেই?

ইয়াসির আরাফাত: গ্যাসের চাপ তো নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আবাসিক এলাকায় সাধারণত গ্যাসের চাপ কম থাকে। তা ছাড়া চাপ বেড়ে গ্যাসের ‘ওভারফ্লো’র বিষয়টি স্পষ্ট নয়। তাহলে কি চাপ বেড়ে সঞ্চালন লাইনের রিলিফ ভালভ থেকে গ্যাসের গন্ধ লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়েছে? বলা হচ্ছে যে শিল্পকারখানায় সরবরাহ বন্ধ থাকায় গ্যাসের চাপ বেড়ে যাওয়ায় এমন ঘটনা ঘটেছে। তাহলে ঈদ ও তার পরের দিনও বন্ধ ছিল, সেদিনও তো এমনটা ঘটতে পারত। কেন গতকাল সোমবার হলো? তাই কারিগরি কোনো ত্রুটির কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে কি না, সে বিষয় খতিয়ে দেখা দরকার।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: তিতাসের গ্যাসের সঞ্চালন লাইনগুলোর ত্রুটি নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে।

ইয়াসির আরাফাত: হ্যাঁ, তিতাসের সঞ্চালন লাইনে যে ত্রুটি আছে, এটা আবার নতুন করে প্রমাণিত হলো গতকালের ঘটনায়। আমরা বিভিন্ন সময় বলে আসছি, তিতাসের সঞ্চালন লাইন অনেক পুরোনো। এগুলোর মেরামত শুধু নয়, ঝুঁকিপূর্ণ লাইনগুলো প্রতিস্থাপন করার প্রয়োজন হবে। এর আগে কয়েকটি বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটেছে এভাবে। এর আগে অনেকগুলো বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, সেখানে বলা হয়েছে যে গ্যাসের উপস্থিতি এসব স্থানে ছিল না। কিন্তু পরবর্তী সময় দেখা গেছে, ঠিকই গ্যাসের উপস্থিতি ঘটনাগুলোর জন্য দায়ী।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: সিদ্দিকবাজার, সায়েন্স ল্যাবের কাছের ভবন এবং মগবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল। আপনি প্রতিটি ঘটনা বিশ্লেষণ করেছেন। তিনটি ঘটনার সঙ্গে গতকাল ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে মিল-অমিল বলুন।

ইয়াসির আরাফাত: সিদ্দিকবাজার, সায়েন্স ল্যাবের কাছের ভবন এবং মগবাজারে বিস্ফোরণের প্রকৃতি একই রকম। বদ্ধ স্থানে গ্যাস জমে থাকলে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে। গতকাল কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। আগের তিন ঘটনার সঙ্গে কালকের ঘটনার সামঞ্জস্যের দিক হলো, ত্রুটিপূর্ণ বা ক্ষতিগ্রস্ত গ্যাসের লাইন লিকেজ বা ছিদ্রের কারণে যে গ্যাস ছড়িয়ে পড়তে পারে বা বদ্ধ স্থানে জমা হতে পারে সেটা। আগের তিনটি ঘটনায় গ্যাস ছাড়া আর কোনো বিস্ফোরক ছিল না। গতকাল বিভিন্ন স্থানের গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়েছে। এই গ্যাস যদি বদ্ধ কোথাও জমা থাকে, তা আবারও বিস্ফোরণের কারণ হতে পারে। তাই এটা বলা যাবে না যে ঝুঁকি চলে গেছে। তবে গতকালের ঘটনার আরেকটি দিক আছে। কারণ, গন্ধ থেকে গ্যাস ছড়িয়ে পড়া বা উপস্থিতি শনাক্ত করা গেছে এবং সতর্কতা অবলম্বন করা গেছে।  

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ঈদের ছুটিতে অনেকেই ঢাকার বাইরে গেছেন। এখন তাঁরা ফিরতে শুরু করেছেন। এ সময় নগরের বিভিন্ন স্থানে গ্যাসের গন্ধ ছড়ানোর ঘটনা ঘটল। নগরবাসীর জন্য আপনার পরামর্শ কী?

ইয়াসির আরাফাত: কোনো বাসায় যদি গ্যাস জমা থাকে, তবে এটি দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। এ জন্য তিতাস থেকেই সতর্কবাণী দেওয়া হয়েছে যে জানালা-দরজা যেন খোলা রাখা হয়। তারপর চুলা জ্বালাতে হবে। রান্নাঘরের জানালা খোলা রাখলে কোথাও গ্যাসের উপস্থিতি থাকলেও মাত্রা কমে যায়। বাতাসের সঙ্গে মিথেনের মিশ্রণ ৫ শতাংশ কম হলে আগুন বা বিস্ফোরণের ঝুঁকি থাকে না। তাই জানালা খোলা থাকলে বা বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা থাকলে বড় ধরনের বিস্ফোরণের আশঙ্কা কম। তাই অবশ্যই জানালা-দরজা খুলে রাখার আধা ঘণ্টা পর গ্যাসের চুলা জ্বালাতে হবে। বাসায় গ্যাসের গন্ধ শনাক্ত করতে পারলে গ্যাসের সংযোগ লাইন বন্ধ করা দরকার। জানালা-দরজা খুলে রেখে গন্ধ দূর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। গ্যাসলাইনের মেরামতও জরুরি।  

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: গ্যাসলাইনের ঝুঁকি প্রশমনে আপনার পরামর্শ কী?

ইয়াসির আরাফাত: এবারের ঘটনায় কোন এলাকাগুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, তার একটা প্রমাণ পাওয়া গেল। এবার সেই অনুসারে ত্রুটি সারানোর ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। একবারে সব এলাকায় হয়তো ত্রুটি সারানোর কাজ করা যাবে না। তবে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ধরে কাজ করা যেতে পারে। এসব এলাকার পাইপলাইনগুলো পরীক্ষা করা, মেরামত করা এবং যেগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সেগুলোতে নতুন পাইপলাইন স্থাপন করা দরকার। নগরজীবনে লাইনের গ্যাস পাওয়া বড় একটা সুযোগ। কিন্তু পুরোনো, ত্রুটিপূর্ণ ও ক্ষতিগ্রস্ত সঞ্চালন বা বিতরণ লাইনের জন্য সেখানে ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। তাই ত্রুটি সারানো এবং প্রয়োজনে নতুন করে লাইন বসানোর বিকল্প নেই।