যারা আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারে, তারা রাজবন্দী হয় কী করে—এমন প্রশ্ন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘তারা তো সন্ত্রাসী, তারা জঙ্গিবাদী এবং তারা অপরাধী। রাজনৈতিক কারণে তো কেউ গ্রেপ্তার নেই। যারা গ্রেপ্তার আছে (তারা) হয় হুকুমদাতা, না হয় সরাসরি অগ্নিসন্ত্রাসে জড়িত, অথবা অর্থ প্রদানকারী। এই হুকুমদাতা, অর্থ প্রদানকারী আর সরাসরি জড়িত কেউ রেহাই পাবে না।’
রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনা এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। বক্তব্যের সময় নির্বাচনের আগে সংঘটিত আগুন-সন্ত্রাসের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে তৈরি করা একটি ভিডিও চিত্র সংসদ কক্ষে বড় পর্দায় দেখান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপির তরফ থেকে দেশে-বিদেশে বারবার লেখা হচ্ছে, তাদের এত লোক অ্যারেস্ট (গ্রেপ্তার)। দেশে-বিদেশে নালিশ করছে তারা। বিএনপির সব নাকি রাজবন্দী। তিনি বলেন, দেশে-বিদেশে নালিশ করে কোনো ফায়দা হবে না। বিদেশিরা কী বলল, সেটা দিয়ে চলবে না। সব দেশের নির্বাচন দেখা আছে। এবারের মতো সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন দেশে হয়নি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
দলীয় সংসদ সদস্যের সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, যারা এ ধরনের অপরাধ (যানবাহনে আগুন দেওয়া) করেছে, যেসব মামলা চলছে, সেই মামলাগুলো যেন যথাযথভাবে চলে। সাক্ষী যেন হয়। তারা (অপরাধীরা) যেন শাস্তি পায়।
সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, লন্ডন থেকে হুকুম আসে। তারা এখানে আগুন দেয়। মানুষ খুন করে। আবার তার (ঘটনার) ছবিও পাঠাতে হয়। কী চমৎকার কথা! ভিডিও কনফারেন্সে হুকুম আসে। তারা তামিল করে। আগুন দিয়ে মানুষ মেরে, পুলিশ মেরে সেই ছবি পাঠায়। তাহলে আর সাক্ষীসাবুদ কী দরকার। তারা নিজেরাই আলামত রেখে দিচ্ছে। তাদের গ্রেপ্তার করলে সেটা রাজবন্দী হয় কী করে?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একজন হাজার মাইল দূরে বসে হুকুম দেয়। আর তামিল যারা করে, তাদের যে বিপদে ফেলে, এটা কি বিএনপির নেতা-কর্মীরা বুঝে না?...আরেকজন বলছে, ছবি গোপনে দাও। ছবি না দিলে তাদের ক্রেডিট (কৃতিত্ব) থাকে না নেতার কাছে। এ কেমন নেতা! দূরে নিজে নিরাপদে থেকে হুকুম চালায়।’
গাজায় ইসরায়েলি হামলার মতো বাংলাদেশেও হাসপাতাল, পুলিশ ও সাধারণ মানুষের ওপর বিএনপি হামলা করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিএনপি বাংলাদেশের জন্য আজরাইল হয়ে এসেছে। ওই দিকে ইসরায়েল করছে, এরা এখন বাংলাদেশের জন্য আজরাইল হয়ে এসেছে। তারা নির্বাচন করবে না, কারণ তারা জানে ভোট পাবে না, সমর্থন পাবে না। জনগণের ওপর আস্থা নেই।’
সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা), কাউন্টার স্যাংশন (পাল্টা নিষেধাজ্ঞা) ও কোভিড অতিমারির পরে মূল্যস্ফীতি ব্যাপকভাবে দেখা দিয়েছে। কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের উন্নত দেশেও এই মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে।
সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য যাতে সহনশীল থাকে। এখানে একটু অদ্ভুত ব্যাপার...দাম বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়। মজুত করা হয়। সেগুলো লক্ষ্য রেখেই মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।’
নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচনে একটি রাজনৈতিক দলসহ তাদের জোট অংশগ্রহণ করেনি। তবে ২৮টি দল নির্বাচনে অংশ নেয়। এই নির্বাচন অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য নির্বাচন কমিশন ও দেশের জনগণসহ সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘জনগণের কাছে আমরা ওয়াদা দিয়েছি। আমাদের লক্ষ্য নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করা। পাঁচ বছর মেয়াদি এ সরকারের সময় ওয়াদা বাস্তবায়ন করব, এটাই আমাদের একমাত্র প্রতিজ্ঞা।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সরকার রপ্তানি বহুমুখীকরণ করবে। প্রতিটি দূতাবাসকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, এখনকার ডিপ্লোমেসি হবে ‘ইকোনমিক্যাল ডিপ্লোমেসি’, শুধু ‘পলিটিক্যাল’ নয়।
বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্যের জবাব
নির্বাচন নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা জি এম কাদেরের বক্তব্যের জবাবে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, ‘খুশি হতাম বিরোধীদলীয় নেতা যদি তাঁর ভাইয়ের ১৯৮৮-এর নির্বাচনটা দেখাতেন। সেই নির্বাচনটা ছিল শুভংকরের ফাঁকি। এরশাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করল খালেদা জিয়া, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে।’
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আগে বিরোধীদলীয় নেতা জি এম কাদের বলেছিলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিন ধরনের নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে কোথাও কোথাও নির্বাচন যেভাবেই হোক, ফলাফল পূর্বনির্ধারিত ছিল এবং ফলাফলের ‘শিট’ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘পঁচাত্তরের পর প্রতিটি নির্বাচন তো আমরা দেখেছি। সেই হ্যাঁ-না ভোট। নির্বাচন কমিশনে তালা দিয়ে ভোটের রেজাল্টই নেই। তিন-চার দিন পর রেজাল্ট। আমাদের বিরোধীদলীয় নেতা দেখালেন...(জি এম কাদের তাঁর বক্তব্যে সপ্তম, অষ্টম ও নবম সংসদ নির্বাচনের ফলাফল ও ভোটের হারের কথা তুলে ধরেন)। তিনি কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদ নির্বাচনের রেজাল্ট দেখাননি। দ্বিতীয় নির্বাচন কীভাবে করেছিল? তৃতীয় নির্বাচনে বিরোধীদলীয় নেতার ভাই (এইচ এম এরশাদ) তখন আরেক মিলিটারি ডিকটেটর (সামরিক স্বৈরশাসক) ক্ষমতায়। এক মিলিটারি ডিকটেটর ভোট চুরির রাস্তা দেখিয়ে গেল। ক্ষমতার দখলটা দেখিয়ে গেল। তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরেকজন...। দুজনেরই একই খেলা। সেনাপ্রধান হলেন, একদিন ক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে গেলেন। একই সঙ্গে দুই রূপ। রাষ্ট্রপতির পদ নিয়ে ভোট চুরি।’
শেষ হলো দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর অধিবেশনের সমাপনীসংক্রান্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ সংসদের বৈঠকে পড়ে শোনান স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি জানান, গত ৩০ জানুয়ারি শুরু হওয়া এই অধিবেশনে মোট কার্যদিবস ছিল ২২টি। প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তরের জন্য ৮৬টি প্রশ্ন জমা পড়ে। এর মধ্যে ৪৫টি প্রশ্নের উত্তর দেন প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রীদের জন্য প্রশ্ন জমা পড়ে ১ হাজার ৮২২টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৮০টি প্রশ্নের উত্তর মন্ত্রীরা দিয়েছেন। একাত্তর বিধিতে জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নোটিশ জমা পড়ে ২৫০টি। এর মধ্যে ১৫টি নোটিশ আলোচনার জন্য গৃহীত হয়। এর মধ্যে ৯টি নোটিশ আলোচিত হয়েছে। বিল পাস হয়েছে দুটি।
অধিবেশনের প্রথম দিনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ভাষণ দেন। এই ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাব উত্থাপন করেন সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই আলম চৌধুরী। পরে এই ভাষণের ওপর সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা আলোচনা করেন। সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ ঘণ্টা রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।