ঢাকার ২৩ বর্গকিলোমিটার সবুজ–ফাঁকা জায়গা ‘গায়েব’: বাপা

‘বৃক্ষনিধন ও তার পরিবেশগত প্রভাব: আমাদের করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্থপতি ইকবাল হাবিব। শনিবার সকালে রাজধানীতে জাতীয় প্রেসক্লাবে
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

গত তিন দশকে ঢাকার সবুজ ও ফাঁকা জায়গা কমেছে প্রায় ২৩ বর্গকিলোমিটার। এই মহানগরে ২০ শতাংশ সবুজ এলাকার প্রয়োজন থাকলেও আছে সাড়ে ৮ শতাংশের কম। এতে গ্রামাঞ্চলের চেয়ে ঢাকায় তাপমাত্রা বেশি থাকে গড়ে সাড়ে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।  

‘বৃক্ষনিধন ও তার পরিবেশগত প্রভাব: আমাদের করণীয়’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় এসব তথ্য তুলে ধরেন স্থপতি ইকবাল হাবিব। আজ শনিবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।

প্রবন্ধে বলা হয়, ১৯৯৫ থেকে ২০২৩ সাল—এই ২৯ বছরে ঢাকা কেন্দ্রীয় নগর অঞ্চলের সবুজ ও ফাঁকা জায়গা ৫২ দশমিক ৪৮ বর্গকিলোমিটার থেকে হ্রাস পেয়ে ২৯ দশমিক ৮৫ বর্গকিলোমিটারে নেমে এসেছে। ঢাকার উষ্ণতম স্থান এবং শহরের বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশসমৃদ্ধ এলাকার মধ্যে দিন ও রাতে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রার পার্থক্য যথাক্রমে ৭ ও ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রার ৭-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের পার্থক্য পৃথিবীর যেকোনো পরিমাপে ভয়ংকর বলে উল্লেখ করেন ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, গ্রামের চেয়ে ঢাকা শহরে সাড়ে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রা পরিমাপ করা যাচ্ছে। অনুভব কিন্তু তার চেয়েও বেশি। পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে গরম অনুভূত হয় বেশি। এতে শিশু ও বয়োবৃদ্ধরা হিটস্ট্রোক করে মারা যাচ্ছেন। অনেকে বলেন, স্ট্রোক করে মারা যাচ্ছেন, যা অযৌক্তিক।

ছায়া ছাড়া এই প্রচণ্ড দাবদাহ থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই উল্লেখ করে বাপার যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হাবিব আরও বলেন, বৃক্ষ ছাড়া ছায়া হয় না।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ঢাকা শহরের বারিধারা পার্ক বারিধারা কমিউনিটিকে দেওয়া হয়েছে। এমন একটা চিত্র চিন্তা করেন যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এখন থেকে আর গাছ লাগাবে না। বা গাছ লাগালেও ওয়ার্ড কমিশনারের নেতৃত্বে ব্লক করে দিয়ে সেখানকার স্থানীয়রাই গাছের রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। তাহলে সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব কমে যায়। সে (সিটি করপোরেশন) গাছ লাগায়, পানিও দেয়। এগুলো হচ্ছে গাছের বাণিজ্য।

আপনি যখন ক্ষমতায় আছেন, আপনার পাতিনেতাদেরও তো কিছু টাকাপয়সা দিতে হয়। এই প্রকল্পগুলো সেই কারণে নেওয়া হয়। না হলে ১৫ বছরের গাছ কেটে বাগানবিলাস চারা কেন লাগানো হবে? এর কোনো যুক্তি তো আমার মাথায় ধরে না।

২০ বছরে হারিয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার হেক্টর ছায়া

স্থপতি ইকবাল হাবিব উপস্থাপিত নিবন্ধে সারা দেশে গাছ কাটায় কী পরিমাণ ছায়া হারিয়েছে, তা–ও তুলে ধরা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ২০০১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশে ২ লাখ ১৪ হাজার হেক্টর গাছের আচ্ছাদন (ছায়া) হারিয়েছে।

নিবন্ধে কিছু প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বৃক্ষশুমারি করা। নগর এলাকাগুলোর পাশাপাশি সব সড়ক ও মহাসড়কে বৃক্ষশুমারি পরিচালনা এবং বৃক্ষসংক্রান্ত তথ্যভান্ডার (ডেটাবেজ) প্রণয়নের মাধ্যমে উন্নয়নমূলক প্রকল্প বা কর্মকাণ্ডের অজুহাতে বৃক্ষ কর্তন নিয়ন্ত্রণ করা। নগর সবুজায়ন নীতিমালা ও কৌশলপত্র প্রণয়ন, ফুটপাত পুনর্বিন্যাস, বৃক্ষ সংরক্ষণ ও রোপণ করা। এছাড়া যশোর-বেনাপোল ৭৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি প্রায় ৯ লাখ ১২ হাজার বর্গফুট সবুজে আচ্ছাদিত, সেটা অক্ষুণ্ন রেখে প্রায় ৩৬ হাজার হেক্টর বনে রূপান্তরিত করা যেতে পারে।

এ ছাড়া কিছু দাবিও তুলে ধরা হয়েছে সংবাদ সম্মেলনে। এর মধ্যে রয়েছে পরিকল্পনাহীনভাবে সড়কদ্বীপে গাছ কাটা বন্ধ করা, এরই মধ্যে কেটে ফেলা গাছ প্রতিস্থাপন করা, রোপণ করা গাছের সংরক্ষণ নিশ্চিত করা, নগরে বনায়ন, গাছ রক্ষা ও কাটার প্রয়োজনে সুনির্দিষ্ট বিধিমালা ও কৌশলপত্র প্রণয়ন করা, যেকোনো প্রকল্পে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন নিশ্চিত করা, বৃক্ষনিধন হয় এ রকম প্রকল্পে অংশীজনের মত নেওয়া, গাছ ও সবুজ অক্ষুণ্ন রেখে উন্নয়ন প্রকল্প করা, নগর এলাকায় গাছ কাটার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের প্রয়োজনীয় নীতিমালা করা, বিদ্যমান আইনে বৃক্ষনিধন বন্ধে আরও কঠোর শাস্তির বিধান আরোপ করা, বিদ্যমান বৃক্ষের সংরক্ষণ ও নতুন বৃক্ষরোপণের কৌশল নির্ধারণ করা ইত্যাদি।

সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম শহীদুল ইসলাম, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিহির লাল সাহা, আবহাওয়াবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক তাওহীদা রশীদ, গ্রিন সেভার্সের প্রধান নির্বাহী আহসান রনি প্রমুখ।

বাপার কোষাধ্যক্ষ মহিদুল হক খানের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করবেন বাপার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির।