মামুনের ক্যামেরায় সুলতান এলেন বেঙ্গলে

‘শতবর্ষে সুলতান’ শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রকাশিত স্মরণিকার মোড়ক উন্মোচন করেন (বাঁ থেকে) আবুল খায়ের, মো. মাহবুব উর রহমান, আহসান এইচ মনসুর, মনিরুল ইসলাম, নাসির আলী মামুন ও মতিউর রহমান। শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর বেঙ্গল শিল্পালয়েছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

এস এম সুলতান যেন আবার ফিরে এলেন। তাঁর দীর্ঘ অবয়ব, মাথা থেকে কাঁধ ছাপিয়ে নেমে যাওয়া ঢেউখেলানো মিশমিশে কালো চুল, খাড়া নাক, কালো আলখাল্লা, পোষা বিড়াল, টিয়ে পাখি আর প্রিয় শিশু-কিশোরের দল নিয়ে। নড়াইলের নিভৃত মাছিমদিয়া গ্রাম থেকে ক্যামেরাবন্দী করে তাঁকে আবার ঢাকায় নিয়ে এলেন স্বনামখ্যাত আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন। সুলতানের অনুরাগীরা এখন তাঁকে পাবেন ধানমন্ডির ২৭ নম্বর সড়কের বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের গ্যালারিতে।

‘শতবর্ষে সুলতান’ নামে বরেণ্য শিল্পী এস এম সুলতানকে নিয়ে আলোকচিত্রশিল্পী নাসির আলী মামুনের আলোকচিত্র প্রদর্শনী আয়োজন করেছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। শিল্পীর জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য এই প্রদর্শনী আয়োজনে সহায়তা করেছে এইচএসবিসি ব্যাংক। শুক্রবার বিকেলে শুরু হওয়া মাসব্যাপী এই প্রদর্শনী চলবে আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। রোববার ছাড়া প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।

শিল্পী এস এম সুলতান ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমিতে ১৯৭৬ সালে তাঁর যে একক শিল্পকর্মের প্রদর্শনী করে দেশের শিল্পী ও শিল্পানুরাগী মহলে বিপুল আলোড়ন তুলেছিলেন, তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে নাসির আলী মামুনের পরিচয়। পরের বছর থেকে মামুন নিবিড়ভাবে সুলতানকে অনুসরণ করেছেন তাঁর ক্যামেরায়। ঢাকায় রমনা উদ্যান থেকে মাছিমদিয়া গ্রাম পর্যন্ত দিনের পর দিন সুলতানকে ধারণ করেছেন তিনি। ব্যক্তি সুলতান, তাঁর জীবনাদর্শ, তাঁর নান্দনিক ভাবনা, শিল্পসৃজন, গ্রামের প্রান্তিক শিশুদের নিয়ে চারুকলা শিক্ষার আজীবন প্রচেষ্টা আর প্রথাগত জীবনযাপনের থেকে অনেকটা আলাদা, অচেনা রহস্যময় সুলতানকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন মামুন। সুলতানের শিল্প সাধনার মতোই মামুনেরও সাধনা ছিল শিল্পীকে ফ্রেমবন্দী করে কাল থেকে কালান্তরে নিয়ে যাওয়া। দর্শকেরা মামুনের সেই সাধনারই দৃশ্যরূপ দেখতে পাবেন এই প্রদর্শনীতে।

‘শতবর্ষে সুলতান’ শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনী ঘুরে দেখেন অতিথিরা। শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর বেঙ্গল শিল্পালয়ে
ছবি: প্রথম আলো

এখানে ছবি আছে ১০৮টি। অধিকাংশই সাদাকালো। প্রতিকৃতি তোলার জন্য নাসির আলী মামুনের খ্যাতি সর্বাধিক। সুলতানের সাদাকালো প্রতিকৃতিগুলোতে তিনি আলোছায়ার রহস্যময়তার যে কাব্যিক ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছেন, তা সুলতানের জীবনের রহস্যময়তাকেই পরিস্ফুটিত করেছে। একটি ছবিতে ঘরের খোলা দরজা দিয়ে আলো আসছে। মেঝেতে মাদুর পেতে বসে সেই আলোতে ছবি আঁকছেন সুলতান। মাছিমদিয়ার সেই ভাঙা পরিত্যক্ত জমিদারবাড়িতে তাঁর বসবাস। শিশুদের নিয়ে ছবি আঁকা। হারিকেনের আলোয় বই পড়া। বাঁশিতে সুর তোলায় নিমগ্নতা। বিড়াল পরিবেষ্টিত হয়ে খেতে বসা—এসব ছবির পাশাপাশি আরও অনেক ছবি আছে, যা থেকে সুলতানের জীবনযাপন আরও নিবিড়ভাবে জানতে পারবেন দর্শকেরা।

প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর বেঙ্গল শিল্পালয়ে
ছবি: প্রথম আলো

প্রদর্শনীতে ছবি ছাড়াও আছে সুলতানকে নিয়ে লেখা নাসির আলী মামুনের বই, সুলতানের লেখা চিঠি, তাঁর আঁকা ছবিসহ বিভিন্ন স্মারক সামগ্রী। প্রদর্শনী উপলক্ষে সিডিং দ্যা সোল নামে একটি স্মরণিকা প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রদর্শনীর উদ্বোধন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রত্যেক শিল্পীই ভিন্ন ভিন্নভাবে নিজেদের নান্দনিক ভাবনা প্রকাশ করে থাকেন। এস এম সুলতান শ্রমজীবী পুরুষ ও নারীদের পেশিবহুল ছবি এঁকে মানুষের শ্রমের শক্তিকেই শৈল্পিকভাবে প্রকাশ করেছেন। অনেক শিল্পীই জীবিতকালে তাঁর প্রতিভার স্বীকৃতি পান না। কিন্তু সুলতান জীবদ্দশাতেই খ্যাতিমান হয়েছিলেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসানের পরই আসে এস এম সুলতানের নাম। তাঁরা বাংলাদেশে শিল্পকলাকে অনেক উচ্চপর্যায়ে নিয়ে গেছেন। নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের কাজ আরও বিকশিত হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের শিল্পকলা আরও সমাদৃত হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

সভাপতির বক্তব্যে সুলতান জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন কমিটির সভাপতি শিল্পী মনিরুল ইসলাম বলেন, ব্যক্তিগত জীবনে এস এম সুলতান ছিলেন শিশুর মতো নিষ্পাপ, সরল একজন মানুষ। তিনি মানুষকে অন্য দৃষ্টিতে দেখেছেন, শিল্পকলায় তুলে ধরেছেন।

নাসির আলী মামুন বলেন, তিনি যেসব ছবি তুলেছেন, বিখ্যাত মানুষের স্বাক্ষর, শিল্পীদের ছবি তাঁর সংগ্রহে আছে, তা নিয়ে ‘ফটোজিয়াম’ নামে একটি জাদুঘর করতে চান। এ কাজে তিনি সবার সহযোগিতা চেয়েছেন।

এইচএসবিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহবুব উর রহমান বলেন, এই প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে শিল্পী এস এম সুলতানের জীবনযাত্রা সম্পর্কে আরও বিস্তৃত ধারণা পাওয়া যাবে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন এ ধরনের প্রদর্শনীসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মপ্রয়াসের ভেতর দিয়ে জনরুচি সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে।

প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর বেঙ্গল শিল্পালয়ে
ছবি: প্রথম আলো

প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, নাসির আলী মামুন ঘনিষ্ঠভাবে সুলতানকে অনুসরণ করেছেন। নাসির আলী মামুন অনেক লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিকসহ গুণী মানুষের ছবি তুলেছেন। মামুনের স্বপ্ন ফটোজিয়াম প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে কেউ এগিয়ে এলে তাঁর স্বপ্ন পূরণ হবে।

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সভাপতি আবুল খায়ের। সঞ্চালনা করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী।

এস এম সুলতানকে তো তাঁর কাজের মধ্যে পাওয়া যাবেই, তবে শতবর্ষের শ্রদ্ধা জানানোর এই প্রদর্শনীতে দর্শকেরা একরকমের সান্নিধ্যও পাবেন শিল্পীর। সে পাওয়া হবে অন্য রকম।