‘মানুষের জীবনকে মূল্য দিন, সবকিছুই পরিবর্তন হয়ে যাবে’

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভায় বক্তারা
ছবি: সংগৃহীত

কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সেটি নিয়ে আলোচনা হয়, সুপারিশ তৈরি করা হয়। কিন্তু এ থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না, সুপারিশেরও বাস্তবায়ন হয় না। ফলে আবার দুর্ঘটনা ঘটে, মানুষের মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনার এই চক্র বন্ধ করতে মানুষের জীবনকে সম্মান ও মূল্য দিতে হবে। ভবনমালিকদের পাশাপাশি রাষ্ট্রকেও এগিয়ে আসতে হবে।  

‘নগরে নাগরিকদের বসবাস ঝুঁকি ও জীবনের নিরাপত্তা’ নিয়ে এক ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। পরিকল্পনা ও উন্নয়ন গবেষণা এবং নীতি বিশ্লেষণী প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) আজ শুক্রবার এ আলোচনার আয়োজন করে।

সম্প্রতি ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন ভবনে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে মৃত্যুর ঘটনাকে গাফিলতিজনিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে উল্লেখ করেন আইপিডির নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, ভবনমালিকদের নিয়ম মানাতে বাধ্য করার দায়িত্বে থাকা সংস্থা ও নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এর দায় এড়াতে পারে না। উন্নত দেশে একটি দুর্ঘটনা ঘটলে এর জন্য দায়ী ও দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়, যাতে পরে এমন দুর্ঘটনা আর না ঘটে। কিন্তু এ দেশে এমন হয় না। মানুষের জীবনকে মূল্য দিতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুর্ঘটনা রোধে যার যা করণীয়, তা করতে হবে। তাঁর মতে, সরকার অবকাঠামো খাতের উন্নয়নে যে ব্যয় করছে, তার ১০ ভাগের ১ ভাগও নিরাপত্তা খাতে ব্যয় করলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমানো সম্ভব।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, আইনের প্রয়োগ ও সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা থাকলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়ানো যাবে। ঢাকা অনুমোদন নিয়ে ভবন তৈরির ক্ষেত্রেও অনিয়ম হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর কারণ, ভবন পরিদর্শকের দায়িত্বে থাকা ইমরাত পরিদর্শক (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের) সরেজমিনে নির্মাণকাজ তদারকি করেন না, আর করলেও ভবনমালিকদের সঙ্গে সমঝোতা করেন। ফলে ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়।

অনুষ্ঠানে রাজউকের প্রধান নগর-পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি কমাতে জরুরিভাবে সাড়া দেওয়ার প্রতি বেশি জোর দিতে হবে। তিনি বলেন, জরুরিভাবে সাড়া দেওয়ার জন্য দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছে কার্যক্রম চালাতে ভবনের সামনে ৩০ ফুট রাস্তা দরকার হয়। কিন্তু ঢাকার ৯০ শতাংশ রাস্তাই ৩০ ফুটের নিচে। নির্মাণে গুণগত মান বজায় রাখতে পারলে নতুন ভবনগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। কিন্তু ইতিমধ্যেই নির্মাণ করা ভবনগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মূল চ্যালেঞ্জ।

দুর্ঘটনার জন্য শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ও গ্যাস নিয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইয়াসির আরাফাত বলেন, ‘এগুলো ছাড়া এখন আমাদের জীবন চিন্তাও করা যায় না। উন্নত দেশেও এগুলোও ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আমাদের ব্যর্থতা হচ্ছে, এগুলো ব্যবহারের ঝুঁকিকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না।’ সিঙ্গাপুরে দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ ও শাস্তির ধরন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে দুর্ঘটনায় (নির্মাণ খাতে) কেউ মারা গেলে দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। এভাবে মানুষের জীবনকে সস্তা করে ফেললে নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না।’  

আইপিডির পরিচালক চৌধুরী মো. জাবের সাদেক বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর বলা হয়েছে, ফায়ার সার্ভিসকে শক্তিশালী করা হচ্ছে। কিন্তু সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের পর দেখা গেল, ভবনটিতে ঠেক দেওয়ার (শোরিং) মতো যন্ত্র ফায়ার সার্ভিসের নেই। আরও কত বড় দুর্ঘটনা ঘটলে অবস্থার পরিবর্তন হবে, প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ‘মানুষের জীবনকে মূল্য দিন, সবকিছুই পরিবর্তন হয়ে যাবে।’

অনুষ্ঠানে ভবনমালিকদের উদ্দেশে প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ খান বলেন, ভবনমালিকদের সচেতন হতে হবে। রাষ্ট্র আপনাকে এ কাজে সহযোগিতা করবে। কোটি টাকা খরচ করে ভবন নির্মাণ করার পর, কোনো কারণে সেটি যদি পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হয়, তবে সেটি মালিকদের জন্য লাভজনক হবে না।  

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন আইপিডির পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফরহাদুর রেজা, পরিকল্পনাবিদ রেদওয়ানুর রহমান প্রমুখ।