রান্নার ঝামেলায় ভরসা ‘ভান্ডারি’ মামার খিচুড়ির দোকান

‘ভান্ডারি’ মামার খিচুড়ির দোকানে মানুষের ভিড়
ছবি: প্রথম আলো

এই ঢাকা শহরে একা মানুষের সংখ্যা কম নয়। এ ধরনের মানুষের জীবনে খাওয়ার কষ্টটা বেশ। কখনো রান্নার খালা না আসা, কখনো বাজার না থাকা, কখনো আলসেমি বা অন্য কোনো কারণে চুলায় উঠে না রান্নার হাঁড়ি। তখন খাবারের সন্ধানে ছুটতে হয় শহরের অলিগলিতে। রাস্তার মোড় কিংবা এক কোণে থাকা ছোট্ট খাবার জায়গাও হয়ে উঠে স্বস্তির।

এমন একা লোকজনের কাছে রাজধানীর উত্তরার কদমফুল মোড় বেশ পছন্দের। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ভ্যানে করে খাবারের পাতিল নিয়ে বসেন কয়েকজন। সেখান থেকে যাঁরা খাবার কিনে নিয়ে যান, তাঁদের প্রায় ৮০ শতাংশ একা থাকেন। কেউ অফিস শেষ করে বাসায় ফেরার পথে, কেউবা বাসা থেকে এখানে এসে খাবার কেনেন।

গত শুক্রবার রাতে গিয়ে ‘ভান্ডারি মামার’ খিচুড়ির ভ্যানের পাশে বেশ ভিড় দেখা গেল। এর মালিক মো. মিলন ওরফে ভান্ডারি। শুরুর দিকে ভান্ডারি মামার খিচুড়ির ভ্যানটাই ছিল। পরে আশপাশে আরও কয়েকজন বাসায় রান্না করে খাবার এনে ভ্যানে রেখে বিক্রি করেন।

গত শুক্রবার রাত ১১টার দিকে গিয়ে দেখা গেল, রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিক সামনে সড়কবাতির আলোর নিচে বসেছে দুটি ভ্যান। তার ওপর বিশাল পাতিলে করে বিক্রি হচ্ছে রান্না করা খাবার। দোকান দুটি ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ৩০ থেকে ৪০ জন। কেউ প্যাকেটে করে খাবার নিচ্ছেন, কেউ খাবার কিনে খাচ্ছেন রাস্তার পাশে বসে।

আগ্রহ নিয়ে কাছে যেতেই ব্যস্ততা দেখা গেল বিক্রেতা মো. রিয়ানের। কথা বলতে চাইলে তিনি অপেক্ষা করতে বললেন। দেখা গেল, ভ্যানে দুটি বড় পাতিল। একটিতে খিচুড়ি, অন্যটিতে তেহারি। তার পাশেই একটি পাতিলে পেঁয়াজ আর শুকনা মরিচমাখা। ক্রেতারা খিচুড়ি বা তেহারি যা-ই কিনুন না কেন, সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে এই পেঁয়াজমাখা। খিচুড়ি ৬০ আর তেহারি বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা করে।

কথা হয় মো. আরিফুল ইসলাম নামের এক বেসরকারি চাকরিজীবীর সঙ্গে। তাঁর স্ত্রী ও পরিবার থাকে গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে। চাকরির কারণে তিনি থাকেন উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের একটি মেসে। এক সপ্তাহ ধরে তাঁর রান্নার খালা অসুস্থ। রান্না হচ্ছে না। তাই অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে এক সপ্তাহ ধরে তিনি রাতের খাবার এখানে খাচ্ছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিক সামনে একটি লোহার রেলিংয়ে বসে খিচুড়ি খাচ্ছিলেন তিন বন্ধু সজীব (২২), ইসমাইল (২২) ও নাঈম (২৬)। তাঁরা তিনজনই এসেছেন গাজীপুরের টঙ্গী থেকে। কথা হলে তাঁরা বলেন, তাঁরা মাঝেমধ্যেই এখানে খেতে আসেন। বিশেষ করে খিচুড়ির সঙ্গে কাঁচা পেঁয়াজ ও শুকনা মরিচমাখা তাঁদের প্রিয়। নাইম বলেন, ‘আমরা তিনজনই মেসে থেকে একটি কারখানায় চাকরি করি। মাঝেমধ্যেই সময় পেলে খিচুড়ি খেতে এখানে চলে আসি।’

কথা বলতে বলতেই ঘড়ির কাঁটায় রাত প্রায় ১২টা। মানুষ কিছুটা কমেছে। বিক্রেতা রিয়ানের চাপ খানিকটা কমেছে। তিনি বলেন, দোকানটি তাঁর মামা মো. মিলন ওরফে ভান্ডারির। সবাই এটাকে ভান্ডারি মামার দোকান হিসেবে চেনে। মামার পরিবর্তে এক সপ্তাহ ধরে তিনি দোকান চালাচ্ছেন। প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় খাবার বিক্রি, চলে রাত একটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত। তাঁর দাবি, প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ মানুষের খাবার বিক্রি করেন তিনি। এর মধ্যে বেশির ভাগই কাজের প্রয়োজনে শহরে থাকা একা মানুষ।

রিয়ানের ভাষ্য, তাঁর মামা একা লোকজনের কথা চিন্তা করেই এভাবে খাবার বিক্রি শুরু করেছিলেন। শুরুতে তাঁদের দোকানে এক-দুজন ক্রেতা থাকলেও এখন তা বেড়েছে কয়েক গুণ। চাকরিজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, রিকশাওয়ালা, গাড়িচালক থেকে শুরু করে নানা শ্রেণি-পেশার লোক এখানে খেতে আসেন। স্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার রান্না করা হয়। বিক্রির সময়ও এ ব্যাপারে নজর রাখা হয়।