সিটি করপোরেশনের বেপরোয়া ময়লার গাড়িতে ৩ বছরে গেছে ১৩ প্রাণ

সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িপ্রতীকী ছবি

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির চাপায় গত তিন বছরে অন্তত ১৩ জনের প্রাণ গেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব দুর্ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সিটি করপোরেশনের চালকদের অনেকেরই ভারী যানবাহন চালানোর লাইসেন্স নেই।

পরিবহনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, নগরবিদ ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের মতে, এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী মূলত সিটি করপোরেশনের বর্জ্য পরিবহনব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা। একাধিক দুর্ঘটনার তদন্তের ঘটনায় গাড়িচালকের গাফিলতি ছিল বলে এসেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও সংস্থাটির পরিবহন বিভাগের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের চিত্র উঠে আসে। সিটি করপোরেশনের গাড়িচালকদের নিজেদের অনুকূলে বরাদ্দ থাকা গাড়ি বহিরাগত লোকদের দিয়ে চালানোরও অভিযোগ রয়েছে।

সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর মুগদা এলাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় এক স্কুলছাত্র নিহত হয়েছে। ওই শিক্ষার্থীর নাম মাহিন আহমেদ (১৩)। মাহিন মতিঝিল সরকারি আইডিয়াল স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল।

সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর গুলিস্তানে প্রাণ হারান নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাঈম হাসান। পরদিন ২৫ নভেম্বর দুপুরে পান্থপথ এলাকায় সংবাদকর্মী আহসান কবির খানের মৃত্যু হয়। সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নাঈমের মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজপথে নেমেছিল শিক্ষার্থীরা।

একই দাবিতে ২০১৮ সালেও আন্দোলন করেছিল শিক্ষার্থীরা। এরপরও পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি, বরং আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান ৬ হাজার ৫২৪ জন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হন অন্তত ১১ হাজার ৪০৭ জন।

আরও পড়ুন

নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাঈম হাসানের মৃত্যুর পর ২০২১ সালের নভেম্বরে প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী ভারী গাড়ি চালাচ্ছেন নিরাপত্তা প্রহরী, অফিস সহায়ক, মশককর্মী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। তাঁরা নিজেদের কাজ বাদ দিয়ে পরিবহন বিভাগের কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে ভারী যানবাহন চালাচ্ছেন। তাঁদের বেশির ভাগেরই ভারী যানবাহন চালানোর লাইসেন্স নেই। বছরের পর বছর এমন কাণ্ড ঘটে চললেও সিটি করপোরেশন জেনেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পরিবহন পুল ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখনো দক্ষ চালকের অভাব রয়েছে। গত কয়েক বছরে দুই সিটিতে কিছু চালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে এখনো চালকের তুলনায় গাড়ির সংখ্যা বেশি।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) দিনের বেলায় ময়লাবাহী গাড়ি চালানো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। রাত ১০টা থেকে সকাল ৭টার মধ্যে বর্জ্য সরানোর কাজ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে ঘোষণা দিয়েই দায় সেরেছে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ। এখনো দিনের বেলায় বর্জ্য পরিবহনের গাড়ি রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায় চলছে।

অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস দায়িত্ব নেওয়ার তিন মাস পর ২০২০ সালের আগস্টে সন্ধ্যার পর বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ করার নির্দেশনা দেন। নির্দেশনা অনুযায়ী, সন্ধ্যা ছয়টা থেকে ভোর ছয়টার মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় বর্জ্য সংগ্রহের সার্বিক কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু অনেক ওয়ার্ডেই এই নির্দেশনা মানা হচ্ছে না।

এ বিষয়ে কথা বলতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান এবং প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাছিম আহমেদের মুঠোফোনে আজ শুক্রবার যোগাযোগ করা হয়। তাঁরা কেউই ফোন ধরেননি।

ময়লার গাড়িচাপায় মৃত্যু নিয়মিত

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ময়লাবাহী গাড়িচাপায় ২০২৩ সালের ৬ মার্চ মারা যান আবু তৈয়ব (২৬) নামের একজন কাপড় ব্যবসায়ী। ২০২২ সালে ময়লার গাড়ি দুর্ঘটনায় অন্তত চারজন মারা যান। ওই বছরের ২ এপ্রিল খিলগাঁওয়ে ডিএসসিসির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নাসরিন খানম নামের এক নারী নিহত হন। ২৩ জানুয়ারি মহাখালীর উড়ালসড়কের কাছে ময়লার গাড়ির ধাক্কায় শিখা রানী ঘরামির মৃত্যু হয়। তিনি ডিএনসিসির পরিচ্ছন্নতাকর্মী ছিলেন।

একই বছরের জুলাইয়ে মিরপুরে পুলিশ স্টাফ কলেজের সামনে ময়লার গাড়ির চাপায় সাব্বির আহমেদ নামের এক তরুণ নিহত হন। ওই বছরের ৩১ মে রাতে মুগদার টিটিপাড়া মোড়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্যবাহী গাড়ির ধাক্কায় নাজমা বেগম নামে এক পথচারী নারী নিহত হন।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় ২০২১ সালে সাতজন নিহত হওয়ার তথ্য জানা গেছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে রাজধানীর গেন্ডারিয়ার দয়াগঞ্জ মোড়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) টেলিফোন বিভাগের কর্মী খালিদ। এপ্রিল মাসে যাত্রাবাড়ীর বিবির বাগিচায় দক্ষিণ সিটির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন এক রিকশাচালক। তখন ক্ষুব্ধ লোকজন ময়লার গাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন।

এ ছাড়া ২০২১ সালের মে মাসে শাহজাহানপুর এলাকায় ময়লার গাড়ির চাপায় একজন এবং ৯ আগস্ট শ্যামপুরের দোলাইরপাড় এলাকায় তৈরি পোশাক কারখানার এক কর্মী নিহত হন। নভেম্বরে মাত্র এক দিনের ব্যবধান প্রাণ হারান নাঈম হাসান ও আহসান কবির খান। ওই বছরের ২৩ ডিসেম্বর ওয়ারী এলাকায় ময়লার গাড়ির ধাক্কায় স্বপন কুমার সরকার নামের আরেকজন নিহত হন।

আরও পড়ুন

নির্দেশনাতেই সীমাবদ্ধ, আইন মানা হচ্ছে না

নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত রাজপথে আন্দোলন করেছিল শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাফিক–ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি কমিটি করা হয়। ওই বছরের আগস্টে কমিটি বেশ কিছু নির্দেশনা দেয়।

প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের কমিটি নির্দেশনা দিয়েছিল, ঢাকায় অবস্থিত সব সংস্থার আওতাধীন যানবাহন এবং কর্মচারীরা যেন ট্রাফিক আইন মেনে চলে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সংস্থার প্রধানদের বিষয়টি নজরদারির নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পরিবহন পুল ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত প্রায় ছয় বছরে সংস্থার চালকদের ট্রাফিক আইন মেনে চলার বিষয়ে আলাদা করে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। বরং সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির চালকদের বিরুদ্ধে নানা সময়ে বেপরোয়া যান চালানোর অভিযোগ পাওয়া যায়।

উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য পরিবহনের গাড়ি
প্রতীকী ছবি

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি সংস্থাগুলো বলেছিল, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তাদের চোখ খুলে দিয়েছে। কিন্তু রাজধানীর সড়ক পরিস্থিতি দেখে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুলে যাওয়া চোখ বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতিদিন সড়কে ঝরছে প্রাণ।

সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর তথ্য অনুসারে, হতাহত ব্যক্তিদের বড় অংশ কর্মক্ষম। দেশে গত তিন মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, এর ১৩ শতাংশই শিক্ষার্থী। গত তিন মাসে দিনে গড়ে দুজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে সড়কে।

পরিবহনবিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িগুলো নয়া ঘাতক হিসেবে দেখা দিয়েছে। এগুলো দুর্ঘটনা না, অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িগুলোতে সব ধরনের অব্যবস্থাপনা বিদ্যমান। এসব ভারী যানবাহনের ফিটনেস সনদ নেই, দক্ষ চালক নেই। সিটি করপোরেশনের জবাবদিহি নিশ্চিত না করলে এমন দুর্ঘটনার সংখ্যা আরও বাড়বে।