অনন্ত-দুরন্তকে নিয়ে মায়ের সংগ্রাম

দুই মেয়ে অনন্ত ও দুরন্তর সঙ্গে মা নাসরিন আহমেদ (ডানে)।  ছবি: সংগৃহীত
দুই মেয়ে অনন্ত ও দুরন্তর সঙ্গে মা নাসরিন আহমেদ (ডানে)। ছবি: সংগৃহীত

অনন্ত একটু রাগী। ছোট বোনের নাম দুরন্ত, তবে খুব শান্তশিষ্ট। সাধারণত দুই বোনের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হয় না। তবে কখনো তেমন হলে তুলকালাম বেধে যায়। তখন পরিস্থিতি সামাল দিতে বড়ই বেগ পেতে হয় তাঁদের মা নাসরিন আহমেদকে। অনন্ত আর দুরন্ত যমজ বোন। বয়স কুড়িতে পড়লেও এখনো শিশুর মতোই রয়ে গেছেন তাঁরা। কারণ, তাঁরা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন তরুণী।

আজ রোববার মা দিবস। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে এবার এক ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে এসেছে দিবসটি। সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও মায়েরা ঘরে থেকে সন্তানদের লালন–পালনে বাড়তি চাপের মধ্যে রয়েছেন। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোতে আর্থিক সংকট প্রকট হচ্ছে। অনেক পরিবারে উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে সংসার সামাল দেওয়া ও সন্তানদের প্রতিপালন করতে গিয়ে মায়েদের প্রচণ্ড সংকটে পড়তে হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গতকাল শনিবার কথা হয় বিশেষ চাহিদসম্পন্ন দুই সন্তানকে নিয়ে জীবনসংগ্রাম করা একাকী এক মায়ের সঙ্গে।

নিজের কথা বলতে গিয়ে অনন্ত–দুরন্তর মা জানালেন, দুই মেয়েকে সামলে রাখতেই তাঁর দিন চলে যায়। মেয়েদের নিয়েই তাঁর সব ভাবনা আর শঙ্কা। স্বামী সাঈদ নাসিম ২০১৫ সালে হৃদ্‌রোগে মারা যান। এরপর থেকে মেয়েদের পুরো দায়িত্বই শুধু তাঁর ওপর বর্তায়নি, এক অভাবনীয় দুর্যোগও নেমে এসেছে তাঁর জীবনে।

আলাপচারিতায় নাসরিন জানালেন একাকী মায়ের কঠিন জীবনসংগ্রামের কাহিনি। স্নাতকে পড়ার সময় তাঁর বিয়ে হয়েছিল। পরে আর পড়ালেখা হয়নি। স্বামী সাঈদ বায়িং হাউসে কাজ করতেন। চাকরিতে উন্নতি হচ্ছিল। প্রথমে মালিবাগে বাসা ভাড়া করে সংসার পেতেছিলেন, পরে লালমাটিয়ায়। বিয়ের দুই বছর পর ২০০০ সালে অনন্ত–দুরন্তর জন্ম। প্রথম থেকেই তাঁদের আচরণে একটু অস্বাভাবিকতা ছিল। অনেক চিকিৎসার পর ২০০৬ সালে অটিজম সম্পর্কে চিকিৎসকেরা নিশ্চিত হন। কিছু করার নেই, বুকে কষ্ট চেপে মা–বাবা মেনে নিয়েছিলেন বাস্তবতা। চিকিৎসকের পরামর্শে চলছিলেন। মেয়েদের আলাদা ঘর ছিল। সেখানে দুই বোনের জন্য নিজস্ব জগৎ গড়ে তুলেছিলেন তাঁরা। এর মধ্যেই আকস্মিক ছন্দপতন। স্ত্রী আর তাঁর দুই মেয়েকে রেখে মারা গেলেন সাঈদ।

নাসরিনের বাবার টানাটানির সংসার। থাকতেন বুয়েটের কর্মচারীদের আবাসিক ভবনের ছোট্ট এক বাসায়। দুই মেয়েকে নিয়ে সেখানেই উঠেছিলেন নাসরিন। ছোট্ট বাসা। ড্রয়িংরুমে তিনজনে মিলে কোনোমতে থাকা। এই অনভ্যস্ত পরিবেশে কিশোরী দুই মেয়েকে নিয়ে মানিয়ে নেওয়াটা ছিল তাঁর পক্ষে খুবই কঠিন এক কাজ।

স্বামীর অফিস থেকে পাঁচ লাখ টাকা পেয়েছিলেন নাসরিন। আর সহকর্মীরা দিয়েছিলেন দুই লাখ। ওই টাকায় সঞ্চয়পত্র কিনে জমা রেখেছেন। ছোট ভাইয়ের সঙ্গে এখন বকশীবাজারে একটি বাড়িতে ভাড়া থাকেন। আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবের সাহায্যে দিন চলে এখন। নাসরিন বলছিলেন, ‘সারাক্ষণ মানুষের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকি, এটা কোনো জীবন না।’ তবে যাঁরা তাঁকে সাহায্য করছেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ তিনি।

মেয়ে দুটোকে নিয়ে এখন তাঁর খুব গর্ব। অনন্ত চমৎকার ছবি আঁকেন, দুরন্ত ভালো নাচেন। তাঁরা পুরস্কারও পেয়েছেন অনেক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে ছবি আঁকায় ২০১৮ সালে জাতীয় পর্যায়ে অটিজম–উত্তরণ ব্যক্তি পুরস্কার পেয়েছেন অনন্ত। দুরন্ত নাচে পুরস্কার পেয়েছেন গত বছর। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন মেয়ে দুটি। তাঁদের বাবা মারা যাওয়ার পর অর্থাভাবে আর পড়াতে পারেননি নাসরিন।

সংগ্রামী এই মা বলছিলেন, মেয়েদের নিয়ে এখন তাঁর দুঃখ নেই। দুশ্চিন্তা শুধু মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। তিনি না থাকলে এই মেয়ে দুটির কী হবে?