অপরাধলব্ধ আয় প্রায় ২০ কোটি, নিজের নামে ব্যাংকে ২ হাজার ৭০০ টাকা

কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকার মোহাম্মদপুরের সাবেক কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবের নামিরা এন্টারপ্রাইজের ব্যাংক হিসাবে তিনি নিজে কোনো টাকা জমা দিতেন না। পরিচিতদের মাধ্যমে তিনি সেই ব্যাংক হিসাবে ১৪ কোটি টাকা জমা করান। ৪ বছরের ব্যবধানে (২০১৫ সালের ১ জুন থেকে ১৫ অক্টোবর ২০১৯) ওই হিসাবে জমা হয় ২১ কোটি টাকার বেশি। অথচ তাঁর নিজের নামে থাকা দুটি ব্যাংক হিসাবে বিভিন্ন সময় জমা হয়েছে ৬ লাখ ২১ হাজার টাকা। আর সেই হিসাবগুলোতে আছে মাত্র ২ হাজার ৭২৯ টাকা।

শুধু যে ব্যাংক অ্যাকাউন্টেই টাকা তা নয়, রাজধানীর মোহাম্মদপুরের মোহাম্মাদিয়া হাউজিং সোসাইটিতে রয়েছে তাঁর ডুপ্লেক্স বাড়ি, যেটির দাম তিন কোটি টাকা। আছে মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধের কাছে সাড়ে সাত কাঠার একটি প্লট। রয়েছে তিনটি গাড়ি।
অর্থ পাচারের অভিযোগে করা একটি মামলায় আদালতে জমা দেওয়া পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, তদন্ত করতে গিয়ে সিআইডি তারেকুজ্জামান ও তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামে ৩৩টি ব্যাংক হিসাবের তথ্য সংগ্রহ করেন। আদালতের নির্দেশে সেসব হিসাবে থাকা টাকার লেনদেন স্থগিত রাখা হয়। ৩৩টি হিসাবের মধ্যে তারেকুজ্জামানের নামে পরিচালিত পাঁচটি ব্যাংক হিসাবের তথ্য ব্যাপকভাবে পর্যালোচনা করে সিআইডি। পরে এই তদন্ত প্রতিবেদন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে।

২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবর ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন ও সিআইডি একটি করে মামলা দেয়। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে তারেকুজ্জামান কারাগারে আছেন।

তারেকুজ্জামান ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। তিনি মোহাম্মদপুর থানা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। এক মুক্তিযোদ্ধাকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগে তাঁকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। পরে আবার তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন।

তারেকুজ্জামান নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন। তাঁর বাবা ছিলেন রডমিস্ত্রি আর চাচা ছিলেন রাজমিস্ত্রি। কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর রাজীবের আর্থিক অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হয়।

তারেকুজ্জামানের কোম্পানি, ২১ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য

নিম্নবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা সাবেক কাউন্সিলর তারেকুজ্জামানের অবৈধ সম্পদের খোঁজ জানার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বিভিন্ন ব্যাংকসহ নানা দপ্তরে চিঠি পাঠায় সিআইডি। সরকারি-বেসরকারি সংস্থার পাঠানো তথ্য পর্যালোচনা করে সিআইডি বলেছে, তারেকুজ্জামানের নামে দুটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। একটি নামেরা এন্টারপ্রাইজ এবং অপরটি নামেরা বিল্ডার্স।

নামেরা এন্টারপ্রাইজের নামে একটি ব্যাংক হিসাবে ৩ বছরের বেশি সময়ে (১৬ মে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালের ১৪ অক্টোবর) জমা হয় ২১ কোটি ৫৬ লাখ টাকার বেশি। বর্তমানে সেটিতে জমা আছে ৯২ লাখ টাকা। আরেকটি হিসাবে এখন আছে ৪ লাখ ১৬ হাজার টাকা।

অন্যদিকে নামেরা বিল্ডার্সের নামে থাকা ব্যাংক হিসাবে ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ থেকে মাত্র ২১ দিনে জমা হয় ১ কোটি ৫০০ টাকা। বর্তমানে সেখানে আছে ৫০ লাখ ৩৮০ টাকা।

আর তারেকুজ্জামানের নিজের নামে থাকা একটি অ্যাকাউন্টে ২০১৫ সালের ২২ মার্চ থেকে ৩ মাসে জমা হয় ৬ লাখ ২০ হাজার টাকা। এখন আছে ১ হাজার ২৯৫ টাকা। তাঁর নামে আরেকটি হিসাবে ৪ বছরে জমা হয় ২ হাজার ৩০৪ টাকা। এখন আছে ১ হাজার ৪৩৪ টাকা।

৪টি ব্যাংকের এই ৫টি হিসাবে ২২ কোটি ৬৬ লাখ টাকার বেশি জমা হয়। সিআইডি তদন্তে দেখতে পায়, এসব অর্থের মধ্যে ১৯ কোটি ৯১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৫০ টাকা অপরাধলব্ধ আয়। বর্তমানে এসব হিসাবে আছে প্রায় দেড় কোটি টাকা, আদালতের নির্দেশে লেনদেন স্থগিত রাখা হয়েছে।

পরিচিত যাঁরা অর্থ জমা করতেন

সিআইডির দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, তারেকুজ্জামান চাঁদাবাজির টাকা নিজে কখনো তাঁর ব্যাংক হিসাবে জমা রাখতেন না। বেশির ভাগ সময় তাঁর কর্মচারী বা বন্ধুকে দিয়ে টাকা ব্যাংকে জমা রাখতেন। বেসরকারি একটি ব্যাংকের এক নারী কর্মকর্তার মাধ্যমে নামেরা বিল্ডার্সের নামে ব্যাংক হিসাব খোলেন। ওই নারী কর্মকর্তার কাছে তারেকুজ্জামান এমন সব লোক পাঠাতেন, যাঁরা লেখাপড়া ভালো জানতেন না। ওই নারী কর্মকর্তা তারেকুজ্জামানের ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা রাখার ব্যবস্থা করতেন। কেবল এই নারী কর্মকর্তা নন, আরেকটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানির পরিচিত ব্যক্তিকে দিয়ে তাঁর ব্যাংক হিসাবে অপরাধলব্ধ এক কোটি টাকার বেশি জমা রাখেন তারেকুজ্জামান।

এর বাইরে তারেকুজ্জামানের ব্যাংক হিসাবে আরও টাকা জমা রাখেন কর্মচারী রাজন শেখ, মহব্বত আলী, সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি ব্যবস্থাপনার কাজ করা সিরাজসহ কয়েকজন।

আদালতে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে সিআইডি বলেছে, বেসরকারি ব্যাংকের নারী কর্মকর্তা, একটি ফোন কোম্পানির কর্মকর্তাসহ যাঁরাই তারেকুজ্জামানের ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা দিয়েছিলেন, তাঁদের প্রত্যেককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিআইডি।
অবশ্য তারেকুজ্জামানের আইনজীবী মো. মেজবাহ উদ্দিন প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তারেকুজ্জামান ঠিকাদারি ব্যবসা করতেন। তাঁর অপরাধলব্ধ কোনো আয় নেই। ব্যবসা করে যে টাকা তিনি আয় করেন, সেটি তাঁর ব্যাংক হিসাবে জমা পড়েছে।

কীভাবে এত সম্পদের মালিক তারেকুজ্জামান

সিআইডির প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, তারেকুজ্জামান অন্যের জমি দখল করে সম্পদের মালিক হন। যেসব জমির মালিক কম প্রভাবশালী কিংবা বিদেশে রয়েছেন, সেসব জমির তথ্য সংগ্রহ করা হতো। এরপর তারেকুজ্জামানের হয়ে এসব জমি দখল করেন নুর মোহম্মদ। তিনি এই মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি। মোহাম্মদপুরের নাজিয়া রহমান নামের এক নারীর তিন কাঠা সম্পত্তি দখল করেন তারেকুজ্জামান। একইভাবে আরও কয়েকজনের জমি দখল করেন তাঁর সহযোগীরা। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্থ আয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় তারেকুজ্জামানের পাঁচ ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে এই মামলার আসামি করা হয়। তাঁরা হলেন শাহ আলম জীবন, কামাল হোসেন, নূর মোহাম্মদ, রুহুল আমিন ও তামজীদ খান। তাঁদের মধ্যে তামজীদ খান গ্রেপ্তার হন।

আসামি শাহ আলম তারেকুজ্জামানের হয়ে মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন যানবাহনের স্ট্যান্ড, ফুটপাতের দোকানসহ নানা জায়গা থেকে চাঁদা আদায় করতেন। অন্যরাও তারেকুজ্জামানের নির্দেশে নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে টাকা আয় করেন।

আর গরুর হাটের ইজারা নেওয়ার জন্য তিন বছরে প্রায় তিন কোটি টাকা খরচ করেন তিনি। তবে ইজারাদার হিসেবে নাম লেখান আরেক সহযোগীর।

তিন বছর আয়কর রিটার্ন দেননি

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যের সূত্র ধরে সিআইডি আদালতকে জানিয়েছে, ২০১৫ থেকে ২০১৬ সালের আয়কর রিটার্ন জমা দেন তারেকুজ্জামান। সেখানে তিনি সম্পদ দেখান ৬০ লাখ ৩৫ হাজারের। অবশ্য এই সম্পদ অর্জনের সপক্ষে বৈধ কোনো উৎস দেখাতে পারেননি রাজীব।

তারেকুজ্জামান ২০১৫-১৬ অর্থবছরের পর ৩ বছর (২০১৬-১৭, ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০) আয়কর রিটার্ন জমা দেননি। তারেকুজ্জামানের নামে বাড়ি ও জমির বাইরেও রয়েছে তিনটি গাড়ি।

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) তথ্যের ভিত্তিতে দেওয়া সিআইডির প্রতিবেদন বলছে, তারেকুজ্জামানের নামে একটি জিপ গাড়ি রয়েছে। এর বাইরে আরও দুটি গাড়ির মালিক তারেকুজ্জামান। এর মধ্যে একটি দুদক জব্দ করেছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সিআইডির ইকোনমিক ক্রাইম স্কোয়াডের তৎকালীন উপপরিদর্শক শামীম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, তারেকুজ্জামানের অপরাধলব্ধ যত আয়, তার তথ্য মিলেছে ১৮ মার্চ ২০২০ পর্যন্ত ব্যাংকসহ সরকারি-বেসরকারি নানা সংস্থার প্রতিবেদনে। তারেকুজ্জামান নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যেভাবে সম্পদের মালিক হন, তা আদালতকে প্রতিবেদন দিয়ে জানানো হয়েছে।