আবার তৈরি করা হলো শতাধিক অবৈধ দোকান

গত ডিসেম্বরে নকশাবহির্ভূত ৭৫৭টি দোকান ভেঙে দেওয়া হয়। মাসখানেক পর আবার দোকান তৈরি শুরু হয়।

নকশাবহির্ভূত দোকান ভেঙে ফেলার পর পুনরায় নির্মাণ করা হচ্ছে। গত রোববার সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেটে
ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর গুলিস্তানের সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেটে আবার নকশাবহির্ভূতভাবে শতাধিক দোকান তৈরি করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক নেতা ও একজন ব্যবসায়ী এই কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের সময় মার্কেটের পার্কিংয়ের জায়গা, বিভিন্ন তলায় হাঁটার জায়গা, ভবনের সৌন্দর্যবর্ধনে রাখা খালি জায়গা থেকে শুরুর করে নকশাবহির্ভূতভাবে দোকান তৈরি করা হয়েছিল। ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, সে সময় মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ ছিল ২০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি মো. সাহাবুদ্দীন ও ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন আহম্মদ ওরফে ম্যাজিক রতনের হাতে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস প্রথম আলোকে বলেন, ‘জানতে পেরেছি, বিভিন্ন মার্কেটে বিভিন্ন নামে আবারও অবৈধভাবে দোকান তৈরি করা হচ্ছে। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করতে এরই মধ্যে আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করেছি। এ ধরনের কার্যক্রম চলমান থাকলে পরবর্তী সময়ে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ডিএসসিসি মালিকানাধীন এই মার্কেটে গত বছরের ডিসেম্বরে বড় পরিসরে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। অভিযানে প্রায় সাড়ে ৭০০ নকশাবহির্ভূত দোকান ভেঙে দেওয়া হয়।

মার্কেটের ব্যবসায়ী ও ডিএসসিসির প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উচ্ছেদ অভিযান শেষ হওয়ার মাসখানেক পরই নকশাবহির্ভূতভাবে দোকান তৈরির কাজ আবার শুরু হয়। শুরুর দিকে এই কাজ গভীর রাতে করা হচ্ছিল। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সরকার কঠোর বিধিনিষেধ জারি করলে মার্কেট বন্ধ থাকে। এ সময় দোকান তৈরির কাজ পুরোদমে এগিয়ে যায়। গত রোববার দিনদুপুরে কাজ চলতে দেখা যায়।

ব্যবসায়ীরা জানান, এবার এসব দোকান তৈরিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন ব্যবসায়ী ফিরোজ আলম ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মান্নাফি। এই দুজনের মধ্যে ফিরোজ কাজ করেছেন ২০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি মো. সাহাবুদ্দীনের প্রতিনিধি হিসেবে।

গত রোববার সরেজমিনে দেখা যায়, মার্কেটের একতলা থেকে চারতলা পর্যন্ত শতাধিক দোকান নতুন করে তৈরি করা হয়েছে। কিছু দোকান তৈরির কাজ এখনো চলছে। কয়েকটি দোকানে রঙের কাজ করছেন শ্রমিকেরা। আবার কিছু কিছু দোকান ইতিমধ্যে চালু হয়ে গেছে। বেসমেন্টে যেসব দোকান ভেঙে ফেলা হয়েছিল, সেখানে নতুন করে আর তৈরি করা হয়নি। এ ছাড়া পাঁচতলায় দোকান তৈরি করা না হলেও তা গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

ডিএসসিসির বাজার শাখার প্রকৌশলীরা বলছেন, তাঁরা ইতিমধ্যে পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দুই দফা প্রতিবেদন দিয়েছেন। প্রতিবেদনে নকশাবহির্ভূতভাবে আবার দোকান তৈরির বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য উপস্থাপনের পাশাপাশি স্থিরচিত্র জমা দেওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মান্নাফি এসব দোকান তৈরির সঙ্গে জড়িত।

মার্কেটের তিনতলায় নকশাবহির্ভূতভাবে তৈরি দোকানে পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে থাকতে দেখা গেল তিন ব্যক্তিকে। দোকান ভেঙে দেওয়ার পর আবার তা তৈরির বিষয়ে জানতে চাইলে নাম না প্রকাশের শর্তে তাঁরা বলেন, তাঁরা দোকানের মালিক নন। ভাড়া হিসেবে দোকান ব্যবহার করছেন। মাসে ভাড়া দিচ্ছেন ২০ হাজার টাকা করে।

ডিএসসিসির প্রকৌশলীদের ভাষ্য, উচ্ছেদ অভিযানের আগে ভুয়া কাগজ তৈরি করে যাঁরা নকশাবহির্ভূত দোকানে ব্যবসা করছিলেন, তাঁরাই নতুন করে দোকান তৈরির পর তা দখলে নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁদের নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দোকান তৈরির সঙ্গে জড়িত চক্রের সদস্যের দিতে হয়েছে। এই টাকার পরিমাণ এক থেকে তিন লাখের মতো বলে তাঁরা শুনেছেন। সে হিসেবে ১০০ দোকান থেকে এক কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।

জানতে পেরেছি, বিভিন্ন মার্কেটে বিভিন্ন নামে আবারও অবৈধভাবে দোকান তৈরি করা হচ্ছে। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করতে এরই মধ্যে আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করেছি।
শেখ ফজলে নূর তাপস, মেয়র, ঢাকা দক্ষিণ সিটি

সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেটটি দক্ষিণ সিটির ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে। নতুন করে শতাধিক দোকান নির্মাণের বিষয়টি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসকে দুবার জানিয়েছেন বলে রোববার দাবি করেন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. মামুন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পুরোনো সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক যুবলীগের নেতা সাহাবুদ্দীনের প্রতিনিধি হিসেবে এবার ফিরোজ আলম নামের এক ব্যবসায়ী এসব দোকান নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতাও এই কাজে জড়িত বলে তিনি শুনেছেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে রোববার ফিরোজ আলমের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি ধরেননি। একপর্যায়ে তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

অন্যদিকে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আবু আহমেদ মান্নাফি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি নকশাবহির্ভূতভাবে দোকান চালুর বিপক্ষে। এক মাস ধরে তিনি অসুস্থ। তাঁর নাম ব্যবহার করে এই কাজ কেউ করে থাকলে তার দায় তিনি নেবেন না।

ডিএসসিসির মালিকানাধীন স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির দেখভাল করে সংস্থাটির সম্পত্তি বিভাগ। জানতে চাইলে প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন প্রথম আলোকে বলেন, করোনা মহামারির কারণে সরকারঘোষিত বিধিনিষেধ বাস্তবায়নের দায়িত্বে পুলিশ ব্যস্ত। তাই পর্যাপ্ত পুলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই এই মুহূর্তে অভিযান চালানো সম্ভব হচ্ছে না।

নকশাবহির্ভূত দোকান উচ্ছেদে ডিএসসিসি মেয়র ইতিমধ্যে নির্দেশনা দিয়েছেন জানিয়ে রাসেল সাবরিন বলেন, লকডাউন উঠে যাওয়ার পর তাঁরা আবার মার্কেটে অভিযান চালিয়ে অবৈধ দোকান ভেঙে দেবেন।