‘ওরা আমার মাথায় মেরেছে’, প্রতিপক্ষ বলছে ‘সে মারতে এসে মার খেয়েছে’

আহত এ এস এম আলী ইমাম
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে সংগঠনের সাবেক এক নেতাকে বেদম মারধর করার অভিযোগ উঠেছে। মারধরে আহত হওয়া সাবেক নেতা বলছেন, তাঁকে রড দিয়ে পেটানো হয়েছে। তবে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, ইমাম ‘নিজে মারতে এসে মার খেয়েছেন’।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টা থেকে ১২টা ১০ মিনিট পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজের শহীদ ডা. ফজলে রাব্বী হলে ওই ঘটনা ঘটে বলে দাবি করা হচ্ছে। অভিযোগকারী এ এস এম আলী ইমাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক উপদপ্তর সম্পাদক ও কলেজ ডিবেটিং ক্লাবের সাবেক সভাপতি। তাঁর অভিযোগ, ভিন্ন ‘গ্রুপের’ অনুসারী হওয়ায় কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ মো. আল-আমিন, সাধারণ সম্পাদক জাকিউল ইসলাম ওরফে ফুয়াদ ও ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের (ইচিপ) সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার খানের নেতৃত্বে তাঁকে রড দিয়ে পেটানো হয়েছে।

অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত সবাই মেডিকেলের কে-৭২ ব্যাচের ছাত্র ও বর্তমানে ইন্টার্ন (শিক্ষানবিশ) চিকিৎসক।

আমার মাথায় অনেকগুলো লাথি মারে

আলী ইমাম প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘পূর্বশত্রুতার জের ধরেই মারধরের ঘটনাটি ঘটেছে। জাকিউল ইসলাম ফুয়াদ আমার সহপাঠী, তাঁর মতো আমিও মেডিকেল ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে প্রার্থী ছিলাম। দায়িত্ব পেয়ে তাঁরা অন্য গ্রুপের কর্মীদের হল থেকে বিতাড়িত করা শুরু করেন। তাঁদের গ্রুপের বাইরে একজনের পর একজনকে টার্গেট করছিলেন। গতকাল আমার পালা ছিল। রাতে আমাকে পুকুরের দিকে ডাকা হয় ইন্টার্নশিপের রোস্টার নিয়ে কথা বলার জন্য। সেখানে শাহরিয়ার, ফুয়াদসহ ১০ থেকে ১২ জন উপস্থিত ছিলেন। যাওয়ার পর প্রয়োজন ছাড়াই তাঁরা আমার সঙ্গে কথা-কাটাকাটি করেন। সভাপতি শেখ মো. আল-আমিনের অনুসারী আমাদের কনিষ্ঠ ইরতিজা ফয়সাল (কে-৭৩ ব্যাচের ছাত্র) আমার মাথায় অনেকগুলো লাথি মারে। এতে আমি চোখে অন্ধকার দেখছিলাম। তখন আমার বমিও শুরু হয়। এরপর গণরুমে নিয়ে যাওয়া হয়। বুঝতে পারছিলাম আমি কোথাও যাচ্ছি, কিন্তু কোথায় যাচ্ছি বুঝতে পারছিলাম না। গণরুমে যাওয়ার পর সেখানেও আমার বমি হয়। এমন অবস্থায়ও তাঁরা আমাকে মারছিলেন। গণরুমে রড রাখা ছিল। কারণ, এর আগেও অনেককে সেখানে পেটানো হয়েছে।’

আলী ইমাম আরও বলেন, ‘সভাপতি শেখ মো. আল–আমিন শাহরিয়ারের হাতে রড তুলে দিয়ে বললেন, “তোরা মার, আমি বাইরে আছি।” দরজা আটকে দিয়ে আল–আমিন বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, যাতে আমাকে বাঁচাতে কেউ না আসতে পারেন। গণরুমে জাকিউল, শাহরিয়ারসহ আট সহপাঠী মিলে আমাকে পেটান। বেশ কয়েকবার তাঁদের কাছে আমি পানি চেয়েছি, বসতে দিতে বলছিলাম। সাড়ে ১১টা থেকে ১২টা ১০ মিনিট পর্যন্ত এই নির্যাতন চলে। মারধরে আমার বাঁ পায়ের ফিবুলায় গুরুতর আঘাত লেগে ফেটে গেছে। এ ছাড়া পুরো শরীরেই আঘাত আছে। আমি পুরো ঘটনাটি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খানকে জানিয়েছি। তিনি ন্যায্য বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন।’

অভিযোগের কোনো প্রমাণ কি আছে

এ ঘটনার বিষয়ে জানতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আল–আমিনকে ফোন দিলে তিনি ধরেননি। পরে সাধারণ সম্পাদক জাকিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমার জানামতে, এ ধরনের কিছু ঘটেনি। হলে কার সঙ্গে কার ব্যক্তিগত সমস্যা, এসব আমার জানার কথা নয়। আমি ঢাকা মেডিকেল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, ক্যাম্পাসে আমার বন্ধু আছে, শত্রুও আছে। কেউ অভিযোগ করতেই পারেন, কিন্তু কোনো প্রমাণ কি আছে? ক্যাম্পাসে কারও সঙ্গে কারও খারাপ সম্পর্কের দায় ছাত্রলীগ নেবে না।’

আমাদের মারধর করার প্রশ্নই আসে না

আর ইচিপের সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার খান বলেন, ‘আমাদের ইন্টার্ন প্লেসমেন্টে রোটেশন হয়। আলী ইমাম গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে ক্যানটিনের পাশের একটি অন্ধকার জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি তখন হলে প্রবেশ করছিলাম। ইন্টার্নে যোগ দেওয়ার বিষয় নিয়ে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। কথাবার্তার একপর্যায়ে তাঁকে কেন মেডিসিন ইউনিটে দেওয়া হলো না, সেই প্রসঙ্গ তুলেই হুট করে তিনি বক্সিংয়ের মোটা একটি পাইপ আমার মাথায় মারেন। আমার হাতে মুঠোফোন ছিল, সেটি দিয়ে আমি তা ঠেকাই। আমার ফোনের ডিসপ্লে ফেটে গেছে, হাতও কেটে গেছে। ওই পাইপ মাথায় লাগলে আমি মারাও যেতে পারতাম। আমাকে আঘাত করার পর কনিষ্ঠ শিক্ষার্থীরা ছুটে এসে ইমামকে জাপটে ধরে ঠেকিয়েছে। তিনি নিজে মারতে এসে মার খেয়েছেন। ইমাম কলেজ ছাত্রলীগের শীর্ষ পদের কোনো প্রার্থী ছিলেন না। তাঁর সঙ্গে আমাদের কোনো শত্রুতাও নেই। তাঁকে আমাদের মারধর করার প্রশ্নই আসে না।’

আমি তাঁদের কীভাবে আঘাত করব

এদিকে জাকিউল ও শাহরিয়ারের বক্তব্যের বিষয়ে আলী ইমাম বলেছেন, ‘সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক তাঁদের দলে। আমি ওখানে একা ছিলাম, ওরা ছিলেন ১০ থেকে ১২ জন। আমি তাঁদের কীভাবে আঘাত করব? অপপ্রচারের মাধ্যমে আমাদের ভিত্তিটাকে দুর্বল করে দেওয়ার চেষ্টা এটা। আমি আঘাত করলে তাঁরা নিশ্চয়ই আহত হওয়ার কথা। কিন্তু সে রকম কিছু তাঁরা দেখাতে পারবেন না। আমার বক্তব্য সম্পূর্ণ সত্য। গণরুমের সামনের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করলেই আমার বক্তব্যের সত্যতা মিলবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ মো. শফিকুল আলম চৌধুরী এই প্রতিবেদককে মেডিকেলের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। মেডিকেলের পরিচালক কর্নেল মো. নাজমুল হকের মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি কল কেটে দেন। এ ছাড়া ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।