ইশরাতের ‘এত এত গুণ আর পরিচয়ের’ পেছনে প্রতারণা

ইশরাত রফিক ঈশিতা
ছবি: সংগৃহীত

আট বছর আগে ইশরাত রফিক ঈশিতা ময়মনসিংহের একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। এর বাইরে চিকিৎসা বিষয়ে তাঁর আর কোনো সনদ কিংবা ডিগ্রি নেই। অথচ ইশরাত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অন্যান্য মাধ্যমে কখনো নিজেকে তরুণ চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিসেবে দাবি করেছেন। কখনো–বা দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। পাশাপাশি নিজেকে তিনি মানবাধিকার কর্মী, সংগঠক, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদার ব্যক্তি দাবি করে প্রতারণা করে আসছিলেন। প্রতারণার অভিযোগে আজ রোববার রাজধানীর মিরপুর এলাকা থেকে চিকিৎসক ইশরাত রফিকসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক হিসেবে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। র‌্যাবের দাবি, গ্রেপ্তারের সময় এই দুজনের কাছ থেকে জব্দ করা হয়েছে ৩০০টি ইয়াবা। পাঁচ বোতল বিদেশি মদ। আর ভুয়া পরিচয়পত্র, ভিজিটিং কার্ড।

র‍্যাবর সংবাদ বিজ্ঞপ্তি বলছে, ইশরাত জাহান একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি নেওয়ার পর ২০১৪ সালে রাজধানীর মিরপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন। সে বছরই একটি সরকারি সংস্থায় চুক্তিভিত্তিক চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ পান ইশরাত। পরে শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে তিনি চাকরিচ্যুত হন। এরপর থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ দাবি করতেন তিনি। তাঁর ভুয়া ডিগ্রিগুলোর মধ্যে আছে এমপিএইচ, এমডি, ডিও ইত্যাদি। এ ছাড়া নিজেকে তিনি ক্যানসার বিশেষজ্ঞ দাবি করে বিভিন্ন মতবাদ প্রচার করতেন। কেবল তা–ই নয়, ইশরাত বিভিন্ন সাইটে চিকিৎসাশাস্ত্রে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশ করতেন। জিজ্ঞাসাবাদে ইশরাত জানিয়েছেন, বিভিন্ন গবেষণাধর্মী প্রকাশনা সম্পাদনা করে তিনি প্রকাশনাগুলো প্রস্তুত করতেন।

র‌্যাব জানিয়েছে, সম্প্রতি ভার্চ্যুয়াল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের মাধ্যমে সংগঠিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণে র‌্যাবের সাইবার মনিটরিং টিম সক্রিয় রয়েছে। ভার্চ্যুয়াল জগত ব্যবহারের মাধ্যমে মিথ্যাচার, বিভ্রান্তি ছড়ানো, অপপ্রচার রোধকল্পে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছে র‌্যাব। র‌্যাব সাইবার মনিটরিং টিমের অনুসন্ধানে জানতে পারে যে একশ্রেণির অসাধু ব্যক্তি বা চক্র ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচার–প্রচারণার মাধ্যমে নিজেকে খ্যাতিমান হিসেবে দেখিয়ে নানাবিধ অবৈধ অপরাধ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার মাধ্যমে অপরাধীরা নিজস্ব অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অপব্যবহার করছে। এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাবের গোয়েন্দা অনুসন্ধানে ভিন্নধর্মী এই প্রতারণা সম্পর্কে তথ্য উদ্‌ঘাটিত হয়। যেখানে বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে নিজের বা নিজেদের আকাশচুম্বী ভুয়া সাফল্য এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও নিরাপত্তাবিষয়ক বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার মিথ্যাচার ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচারে লিপ্ত রয়েছে এই অসাধু ব্যক্তি বা চক্রগুলো। অনুসন্ধানে উদ্‌ঘাটিত হয়, এ জাতীয় মিথ্যাচারের মাধ্যমে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এই প্রতারকেরা।

শহীদুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

র‍্যাবের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, ইশরাত রফিক জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানান, তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিদেশ থেকে পাওয়া ভুয়া সাফল্য নানাভাবে প্রচারণা চালাতেন। গত বছর ভারতের উত্তর প্রদেশে হোটেল পার্ক অ্যাসেন্টে অনুষ্ঠিত জিআইএসআর ফাউন্ডেশনের দেওয়া ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘রিসার্চ অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’, ‘ভারতের টেস্ট জেম অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন। প্রতারণার মাধ্যমে ভুয়া নথি উপস্থাপন করে ২০১৮ সালে জার্মানিতে লিন্ডা ও নোবেল লরিয়েট মিট-মেডিসিনে অংশ নেন। পরে তিনি প্রচারণা চালান, একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে প্রথম তিনি ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন।

মহামারির সময় ইশরাত নিজেকে আলোচক হিসেবে উপস্থাপন করেন। র‍্যাবের সংবাদ বিজ্ঞপ্তির তথ্য অনুযায়ী, আসামি ঈশিতা অনলাইনে করোনা প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন ও সার্টিফিকেট প্রদান করতেন। এ ছাড়া ঈশিতা ‘ইয়ং ওয়ার্ল্ড লিডারস ফর হিউম্যানিটি’ নামের একটি অনিবন্ধিত সংগঠন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। সংস্থাটির সদর দপ্তর নিউইয়র্কে বলেও প্রচারণা চালাতেন তিনি। এই ফেসবুক পেজের অ্যাডমিন ঈশিতা। এই ফেসবুক পেজের মাধ্যমে আসামি দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রতারণার নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন। ইতিমধ্যে টাকার বিনিময়ে নেপাল, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, বুরুন্ডি, আমেরিকা, নাইজেরিয়া, ওমান, সৌদি আরবে প্রতিনিধি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এই সংগঠনের ব্যানারে সেমিনার, অ্যাওয়ার্ড, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি আয়োজন করতেন ঈশিতা।

র‍্যাব বলছে, ইশরাত ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ কমিশনসহ নয়টি আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদস্য। প্রতারণার কৌশল হিসেবে আসামি নিরাপত্তা বাহিনীর র‌্যাংক, ব্যাচ ও পদ অর্জনের চেষ্টাও চালান। এর অংশ হিসেবে ফিলিপাইন পরিচালিত একটি ওয়েবসাইট থেকে ৪০০ ডলার বিনিময়ে সামরিক বাহিনীর ন্যায় ‘ব্রিগেডিয়ার জেনারেল’ পদ পান বলে আসামি জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। আর তাঁর সহযোগী হিসেবে ছিলেন অপর আসামি শহিদুল ইসলাম। শহিদুল নিজেকে আইন সহায়তাকেন্দ্র, ইয়াং ওয়ার্ল্ড লিডার ফর হিউম্যানিটিসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে দাবি করতেন।