ঈদে গরুর মাংস ‘খাওয়া হচ্ছে না’ শাহনাজদের
মাংস, ডিম ও দুধ বিক্রির গাড়ি এসেছে, এমন খবর পেয়ে কাজ ফেলে ছুটে গিয়ে বেলা ১১টার দিকে গাড়ির পেছনে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন শাহনাজ বেগম। প্রায় আধঘণ্টা পর তাঁর সামনে যখন আরও প্রায় ১৫ জন নারী দাঁড়ানো, তখন জানতে পারেন গরুর মাংস শেষ। তবে আশা ছিল ব্রয়লার মুরগি হলেও হয়তো পাবেন। কিন্তু দুপুর ১২টার দিকে যখন তাঁর সুযোগ আসে, তখন গাড়িতে শুধু দুধ আর ডিম ছিল। ১০০ টাকায় ১৫টি ডিম, আর ৬০ টাকায় ১ লিটার দুধ কেনেন তিনি।
পরে শাহনাজ বেগম প্রথম আলোকে বলেন, অভাবের কারণে বছরের অন্য সময়ে গরুর মাংস কেনা হয় না। তাই ভেবেছিলেন, ঈদে অন্তত সন্তানদের গরুর মাংস খাওয়াবেন। এখন কী করবেন, জানতে চাইলে এই নারী বলেন, ‘বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ৭০০ টাকা। এত দামে কেনার সামর্থ্য নেই। তাই এ বছর গরুর বদলে সোনালিকা (কক) মুরগি কিনব।’
রমজান মাসে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সুলভ মূল্যে গরুর মাংস, খাসির মাংস, ব্রয়লার মুরগি, দুধ ও ডিম বিক্রির শেষ দিন ছিল আজ শনিবার। এদিন মোহাম্মদপুরের সূচনা কমিউনিটি সেন্টারের সামনে গাড়ি পৌঁছায় সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে। পণ্য গুছিয়ে বিক্রি শুরু হয় বেলা ১১টার কিছু পরে।
আজ ওই গাড়িতে গরুর মাংস আনা হয়েছিল ২০ কেজি। খাসির মাংস ৫ কেজি, ব্রয়লার মুরগি ৪০টি (এক কেজি ওজনের), দুধ ৫০ লিটার এবং ডিম ছিল ১ হাজার ২০০টি। বিক্রি শুরুর প্রায় আধঘণ্টা পরই বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গরু ও খাসির মাংসের বিক্রি শেষ হয়। ব্রয়লার মুরগি শেষ হয় পৌনে ১২টার দিকে। আর সোয়া ১২টার দিকে শেষ হয়ে যায় সব বিক্রি।
শাহনাজ বেগমের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁর বাসা মোহাম্মদপুরের টিক্কাপাড়া এলাকায়। স্বামী শওকত আলী ৪ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। তাঁর দুই মেয়ে ও এক ছেলে। তিনজনই উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। তাঁর একার রোজগারেই সংসার চলে। সন্তানেরা পড়াশোনায় ভালো, তাই কষ্ট হলেও সন্তানদের পড়াশোনা করাচ্ছেন। সম্প্রতি ছেলেটি পড়াশোনার পাশাপাশি একটি দোকানে বিক্রয়কর্মীর কাজ নিয়েছেন। ছেলের উপার্জনের টাকায় অন্তত সন্তানদের পড়াশোনার খরচটা আসবে বলে আশা করছেন তিনি।
নিজের উপার্জনের বিষয়ে শাহনাজ বেগম জানান, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দুটি বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করেন। বাকি সময় করেন কাপড় সেলাইয়ের কাজ। মোহাম্মদপুর এলাকার বিভিন্ন টেইলার্স থেকে হাতে সেলাইয়ের যে কাজগুলো থাকে, সেগুলো এনে বাসায় কাজ করেন। এই কাজে তাঁর দুই মেয়েও সহায়তা করেন। বাসাবাড়িতে কাজ করে পান ৪ হাজার টাকা। আর সেলাই থেকে ৭-৮ হাজার টাকা পান।
সুলভ মূল্যে মাংস, দুধ ও ডিম কিনতে শাহনাজের মতো আরও অনেক স্বল্প আয়ের মানুষ ভিড় করেছিলেন। সকাল সাড়ে ১০টায় সূচনা কমিউনিটি সেন্টারের সামনে গিয়ে দেখা যায়, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের গাড়ি তখনো সেখানে পৌঁছায়নি। কিন্তু তখন সেখানে প্রায় ৫০ জন নারী-পুরুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। এর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ছিল বেশি। আসাদ ইসলাম নামের এক তরুণ একটি কাগজে নামের তালিকা করেন। তালিকা অনুযায়ী বিক্রি শুরুর আগেই সেখানে মোট ৫৯ জন নারী ও পুরুষ ছিলেন। পরে আরও অনেকেই পণ্য কেনার জন্য লাইনে দাঁড়ান।
পণ্য বিক্রির একেবারে শেষে শুধু ৮টি ডিম কেনার সুযোগ পান রিং রোডের বাসিন্দা খায়রুল ইসলাম। বিক্রেতার কাছে খুচরা ৫ টাকা না থাকায় ওই ডিমের দাম ৫০ টাকা রাখেন তিনি।
সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন জানিয়ে খায়রুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইচ্ছে ছিল যা পাই তাই কিনব। কিন্তু পেলাম শুধু ৮টি ডিম। ঈদের আগে চাহিদা বেশি হয়। তাই বরাদ্দ আরও বেশি থাকলে ভালো হতো।’ তাঁর মতো লাইনে দাঁড়ানো অনেকেই গরুর মাংস না পেয়ে মন খারাপ করে ফিরে যান।
বরাদ্দ কমের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (উৎপাদন) মোহাম্মদ রেয়াজুল হক মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সুলভ মূল্যে বিক্রয় কর্মসূচির শেষ দিন ছিল। মানুষ থাকবে কি না, বিক্রি হবে কি হবে না, না হলে পচে যাবে—এসব নানা চিন্তায় বরাদ্দ খুব সীমিত করা হয়েছে। এ ছাড়া যেসব জায়গায় সাধারণত ক্রেতা বেশি থাকে, সেখানে বরাদ্দ একটু বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সূচনা কমিউনিটি সেন্টারের সামনে শুরু থেকেই তুলনামূলক ক্রেতা কম ছিল।
শেষ দিনে আজ রাজধানীর ১৫টি জায়গায় মাংস, দুধ ও ডিম বিক্রি করেছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। সব মিলিয়ে গরুর মাংস ১ হাজার কেজি, খাসির মাংস ৮০ কেজি, ড্রেসড ব্রয়লার মুরগি ৭৫০টি, দুধ ১ হাজার ৫০০ লিটার এবং ২৫ হাজার ডিম বরাদ্দ দেওয়া হয়।