উন্নয়নের নামে উচ্ছেদ চলছে: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ফাইল ছবি

বান্দরবানে ম্রো জনগোষ্ঠীর আবাসস্থলে হোটেল নির্মাণ বন্ধের দাবি জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, বান্দরবানে ম্রো জনগোষ্ঠীর আবাসস্থলে হোটেল, রিসোর্ট নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ অবৈধ, অন্যায় ও অমানবিক। অবিলম্বে এটি বন্ধ করতে হবে।

বান্দরবানে ম্রো জনগোষ্ঠীর ভূমিতে হোটেল ও রিসোর্ট নির্মাণের প্রতিবাদে আজ শনিবার দুপুরে ভার্চ্যুয়াল এক সংবাদ সম্মেলনে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এসব কথা বলেন। বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) যৌথভাবে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সেখানে ম্রো সম্প্রদায়ের মানুষের জমি দখল করা হচ্ছে। উন্নয়নের নামে উচ্ছেদ চলছে। এই উচ্ছেদ সম্পূর্ণ মানবতাবিরোধী। দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

স্বাগত বক্তব্যে বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, দারিদ্র্যের সূচকে বান্দরবানের অবস্থা বেশ খারাপ। সেখানে এমন বিলাসী হোটেল কেন করতে হবে? পরিবেশ সংবেদনশীল এমন একটি জায়গাকে ধ্বংস করা হচ্ছে। এটা শুধু ম্রো জনগোষ্ঠীর অধিকার না, পুরো দেশের মানুষের বিষয়।

রাঙামাটির সার্কেলপ্রধান দেবাশীষ রায় বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ম্রোদের সংখ্যা কমছে দিন দিন। তাদের অনেকেই মিয়ানমারে চলে গেছে। প্রাকৃতিক সম্পদ ভোগদখল করে ম্রো জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করার এই ঘটনা লজ্জাজনক।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, বান্দরবানে যে উন্নয়ন করা হচ্ছে, সেখানে মানুষের, প্রাণ–প্রকৃতির, ঐতিহ্যের কোনো গুরুত্ব নেই। এতে আছে মুনাফা, যেখানে রাষ্ট্রীয় সংস্থা মুনাফা করবে। দেশের উন্মুক্ত বনাঞ্চল, নদী, জলাভূমি, বন হারিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের নামে এক ভয়ংকর বিপদের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।

আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁদের মূলমন্ত্র অর্থ উপার্জন করা যৌক্তিক বা অযৌক্তিক যেকোনোভাবে। প্রতিষ্ঠানগুলোরও লক্ষ্য একই, মুনাফা অর্জন করা। বান্দরবানে হোটেল নির্মাণ প্রকল্পে একটি বিতর্কিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা আছে। এই সম্পৃক্ততা হতাশার।

অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, বান্দরবানে যে পরিষদ ওই ভূমি লিজ দিয়ে হোটেল নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে, সেই অনুমতি দেওয়ার এখতিয়ার তাদের নেই। জমি লিজ নেওয়ার জন্য যেসব শর্ত ছিল, তা মানা হয়নি।

অনুষ্ঠানে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে বান্দরবানে এমন ঘটনা দুঃস্বপ্নের। কোন যুক্তিতে ব্যবসার নামে নাগরিকের অধিকার হরণ করা হচ্ছে? এর উদ্যোক্তারা তাঁদের ভুল বুঝুক, এটাই চাওয়া। তা না হলে এই পদক্ষেপ আত্মঘাতী হয়ে যাবে।

এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, বান্দরবানে প্রকৃতি পরিবেশ ধ্বংস করে যে হোটেল ব্যবসা শুরু করা হচ্ছে, এটি করার অধিকার ওই সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের আছে কি না। এটি খতিয়ে দেখা উচিত। এই অবৈধ প্রকল্পের তদন্ত হওয়া দরকার।
যেভাবে বান্দরবানে হোটেল নির্মাণ করা হচ্ছে, তা দেশের সংবিধান, আইন ও পার্বত্য চুক্তির পরিপন্থী বলে মত দেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম।

আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, পার্বত্য জেলাতে এমন একটি স্থাপনা করার আগে বাসিন্দা, কর্তৃপক্ষের যে মতামত নেওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। এতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হয়েছে। বিতর্কিত এ কাজ করে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে।

নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবির বলেন, ‘বাংলাদেশে আবার পাকিস্তানি কায়দায় জনগোষ্ঠীদের তাড়ানো হোক, এটা আমরা চাই না। বান্দরবানে উন্নয়ন নয়, মুনাফার জন্য এটা করা হচ্ছে। এটি প্রকৃতিবহির্ভূত, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবিরোধী।’

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং। মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান। তিনি বলেন, বান্দরবানে ওই হোটেল প্রকল্প তৈরি হলে সেখানে ছয়টি গ্রামের ১১৬টি পাড়ার প্রায় ১০ হাজার ম্রো বাসিন্দা উচ্ছেদের মুখে পড়ে তাঁদের জীবিকা স্থায়ী ক্ষতিতে পড়বে। সেখানকার ঐতিহ্যবাহী জীবনাচার, পরিবেশ, প্রকৃতি নষ্ট করে মুনাফা, আয়েশি বিনোদন ও ভোগবিলাসের জন্য এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলন থেকে তিন দফা দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হলো বান্দরবানে ম্রো–অধ্যুষিত এলাকায় হোটেল ও রিসোর্ট নির্মাণ বন্ধ করা, সেখানে আন্দোলনরত জনগোষ্ঠীকে ভয়-হুমকি খতিয়ে দেখে বন্ধ করা, পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিদের সুরক্ষা দিতে বিধি প্রণয়নসহ ভূমি কমিশনকে সক্রিয় করা।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ইত্তেফাকের সম্পাদক তাসমিমা হোসেন, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক নীনা গোস্বামী প্রমুখ।