উন্নয়নের নামে পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে: বিআইপি

বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি হওয়ায় উদ্যান হারাচ্ছে তার আসল রূপ
ফাইল ছবি

উন্নয়ন প্রকল্পের নামে রাজধানীর উদ্যান, পার্কগুলোর গাছপালা, পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)। নগরবিদদের এ সংগঠন বলছে, উদ্যান, পার্কগুলোর গাছ কেটে কংক্রিটের স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কেটে রেস্টুরেন্ট ও পার্কিং নির্মাণ, যা দেশের বিদ্যমান আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

আজ রোববার ‘উদ্যান-পার্কের উন্নয়ন প্রকল্প ও প্রকৃতি-পরিবেশ সুরক্ষা’ শীর্ষক পরিকল্পনা সংলাপের আয়োজন করে বিআইপি। সংলাপ থেকে অবিলম্বে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্নয়ন কার্যক্রম বন্ধের দাবি জানানো হয়। সংশ্লিষ্ট অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের মতামত ও গণশুনানির মাধ্যমে নকশা প্রণয়নের পর উন্নয়ন কার্যক্রম পুনরায় শুরুর পরামর্শ দেন নগরবিদেরা।

সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইপির সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান। তাতে বলা হয়, বর্তমানে ঢাকা বায়ুমানের দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহর, ঢাকার তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে এবং ঢাকার বায়ুমণ্ডলে মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। বিআইপির গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় সবুজ আচ্ছাদন আছে মোট আয়তনের মাত্র ৯ দশমিক ২ শতাংশ, যা কমপক্ষে ২৫ শতাংশ থাকার কথা। আর শহরের ৮১ দশমিক ৮২ শতাংশ এলাকাই কংক্রিটে আচ্ছাদিত।

প্রবন্ধে বলা হয়, ঢাকার অক্সিজেনের আধার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে উদ্যানের গাছপালা, পরিবেশ-প্রতিবেশ বিনষ্ট করা হচ্ছে। ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, পার্ক ও খোলা পরিসরের ৫ শতাংশের বেশি জায়গায় অবকাঠামো হতে পারবে না। অথচ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্নয়ন প্রকল্পে কংক্রিটে আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ ৩৭ শতাংশ। গাড়ি পার্কিং, রেস্তোরাঁ নির্মাণের যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চরিত্র নষ্ট হবে, যা বিদ্যমান ‘উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০’–এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

সংলাপে জানানো হয়, শুধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নয়, সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর বেশ কিছু উদ্যান, পার্কের উন্নয়নে প্রকৃতি ধ্বংস করে কংক্রিটের কাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে। যেমন ওসমানী উদ্যানে ৫২ শতাংশ, বনানী পার্কের ৪২ শতাংশ ও গুলশান-২ নম্বরের বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ পার্কের ৩৮ শতাংশ কংক্রিটে আচ্ছাদিত এলাকা। এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, প্রায় সব উন্নয়ন প্রকল্পেই প্রকৃতি ধ্বংসের একই চিত্র দেখা যাচ্ছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক এবং বিআইপির সভাপতি আকতার মাহমুদ বলেন, সরকারের বিভাগগুলো প্রতিযোগিতায় নেমেছে কে কত টাকার প্রকল্প নিতে পারে। জরুরি না অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প, সেটি ব্যাপার নয়। যেনতেনভাবে একটি প্রকল্প নিয়ে টাকা খরচ করা হচ্ছে। গাছ কেটে, কংক্রিট দিয়ে ঢেকে উদ্যানের চরিত্র বদলে ফেলা হচ্ছে।

স্থাপত্য অধিদপ্তরের করা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্নয়ন প্রকল্পে দেশের বিদ্যমান পরিকল্পনা, পরিবেশ ও উন্নয়নসংশ্লিষ্ট আইন-বিধিবিধান অনুসরণ করা হয়নি বলে অভিযোগ করে বিআইপি। সংগঠনটি বলছে, পার্কের ক্ষেত্রে বড় ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প নিতে গেলে ইমারত নির্মাণ বিধিমালার আওতায় গঠিত ‘নগর উন্নয়ন কমিটি’র মতামত নেওয়া বাধ্যতামূলক। অথচ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রকল্পের পরিকল্পনা নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমোদন নেওয়া হয়নি।

বিআইপি জানায়, উদ্যানের প্রকল্প প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের সমন্বয়ে নকশা প্রণয়ন করতে হয়। পাশাপাশি উদ্যানের ব্যবহারকারীসহ অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রকল্পের পরিকল্পনায় বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন নেওয়া হয়নি। জনগণের মতামতের জন্য গণশুনানি ছাড়াই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বিআইপি মনে করে, পরিকল্পনা পদ্ধতি অনুসরণ না করে প্রকল্প বাস্তবায়নের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা চূড়ান্তভাবে অপেশাদারি আচরণ। এতে গণপরিসরের ওপর জনগণের যে অংশীদারত্ব রয়েছে, তারও অবমূল্যায়ন হয়েছে।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রকল্পের পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, প্রকৃতি ও পরিবেশকে অক্ষুণ্ন রেখেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় স্থানগুলোকে সংরক্ষণ করা সম্ভব। অংশীজনদের পরামর্শ নিয়ে গণশুনানির মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্পের নকশা প্রণয়ন করা যেত।

তদন্ত সাপেক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বৃক্ষনিধন ও পরিবেশের ক্ষতিসাধনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানায় বিআইপি। সংলাপে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে প্রকল্প প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের অন্তর্ভুক্ত করা, ইমারত নির্মাণ বিধিমালার আওতায় গঠিত নগর উন্নয়ন কমিটির মতামতের ভিত্তিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্নয়ন প্রকল্পের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং উদ্যান-পার্কের উন্নয়নে কংক্রিটের অবকাঠামো নির্মাণের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃতি-পরিবেশকে অক্ষুণ্ন রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা করা।