করোনার ক্ষত নিয়ে ঝুলছে ‘টু-লেট’

করোনার সময় আয় হারিয়ে ঢাকা ছেড়েছেন অনেকে। কেউবা কম ভাড়ার বাসায় উঠেছেনছবি: প্রথম আলো

ধানমন্ডির ৭/এ, ৮/এ (পুরোনো ১৫ নম্বর), শংকর, কলাবাগানের লেক সার্কাস রোড ও বশিরউদ্দিন সড়ক ঘুরে খুব কম বাড়ি পাওয়া গেলে যেখানে ‘টু-লেট’ বা ‘বাসা ভাড়া হবে’ লেখা দেখা যায়নি। প্রায় সব বাসার গেটেই এ রকম লেখা ঝুলছে।

মার্চে করোনার সংক্রমণের পর সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে জনসাধারণের চলাচল সীমিত করে দেয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। সীমিত আয়ের মানুষের কাজের পথও বন্ধ হয়ে যায়। কর্মহীন হয়ে অনেকে ঢাকা ছাড়েন।

অনেকে আবার বেশি ভাড়ার বাসা ছেড়ে কম ভাড়ার বাসায় ওঠেন। করোনার পর জনজীবন সচল হলেও টু-লেট পরিস্থিতির খুব পরিবর্তন হয়নি।এখনো চারদিক তাকালেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসা খালি দেখা যায়।

গত মে মাসে ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ২ হাজার ৩৭১ জনের সাক্ষাৎকার নিয়ে ব্র্যাক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেখানে বলা হয়, ৩৬ শতাংশ লোক চাকরি বা কাজের সুযোগ হারিয়েছেন। ৩ শতাংশ লোক চাকরি থাকলেও বেতন পাননি। আর দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের ৬২ ভাগই কাজের সুযোগ হারিয়েছেন। করোনার কারণে ১০টি জেলার মানুষের আয় কমে গেছে। ঢাকা জেলার মানুষের আয় কমেছে ৬০ ভাগ।

পণ্য আমদানির ব্যবসা করেন ইশতিয়াক হুসাইন। গুলশানে তিনি যে বাসায় থাকতেন তার ভাড়া ছিল ৯৬ হাজার টাকা। কিন্তু দেশে করোনা আসার আগেই বহির্বিশ্বে করোনার সংক্রমণের কারণে বছরের শুরুতেই আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার যে ব্যবসার ধরন তাতে টাকা বাকিতে রেখে পণ্য আমদানি করতে হয়। বাইরের দেশে সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমার টাকা আটকে যায়। আবার নতুন পণ্যও আনতে পারছিলাম না। দেশে বিক্রি কমে যায়। দোকানে দোকানে টাকা বাকি পড়ে যায়। তাই আমাকে খরচ কমানোর কথা ভাবতে হয়।’

ইশতিয়াক হুসাইন এখন গুলশান ছেড়ে নিকেতনে চলে এসেছেন, যার ভাড়া সবসহ ৪২ হাজার টাকা।

এপ্রিল-মে মাস থেকেই রাজধানীতে অনেকে বাসা ছাড়তে শুরু করেন এবং কম ভাড়ার বাসায় চলে যান। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক বাড়িওয়ালাও বিপাকে পড়েন। ধানমন্ডিতে বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকায় সাতমসজিদ সড়কের ৭/এ, ৮/এ (পুরোনো ১৫ নম্বর), শংকরসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রচুর শিক্ষার্থী বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন। কিন্তু ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

শিক্ষার্থীরাও অনেকে ঢাকা ছাড়েন। প্রথমে এক-দু মাসের ভাড়া দিয়ে যেতে পারলেও পরে কারও ভাড়া বাকি পড়ে থাকে, কেউবা বাসা ছেড়ে দেন।

ধানমন্ডি ৮/এ সড়কের একটি বাড়ির মালিক মো. সুলাইমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাসায় অনেক ব্যাচেলর থাকত। কিন্তু ভার্সিটি বন্ধ হওয়ার পর ওরা চলে যায়।

এপ্রিলের ভাড়া দিলেও পরে দু মাসের ভাড়া বকেয়া থাকে। পরে পুরো টাকাও দিতে পারেনি। জুলাইয়ে ওরা সব বাসা ছেড়ে দেয়। আমার বাড়িই প্রায় খালি হয়ে যায়।’

সুলাইমান জানান, তাঁর ১২টি ফ্ল্যাটের ছয়টিতে শিক্ষার্থীরা থাকতেন। করোনার সময়ে ৭টি ফ্ল্যাট খালি হয়। সেপ্টেম্বরে গিয়ে তিনি আবার ভাড়া পেতে শুরু করেন। যদিও এখনো তিনটি ফ্ল্যাট খালি আছে।

কলাবাগানের লেক সার্কাস সড়কেও অনেক বাসায় টু-লেট ঝুলতে দেখা যায়। একটি বাসার মালিক সায়েম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার বাসা খালি হওয়ার পরিমাণ বেশি। করোনার শুরুর দিকে তাঁর দুই ভাড়াটিয়া কম ভাড়ার বাসায় ওঠার জন্য তাঁর বাসা ছেড়ে দিয়েছেন। তিন মাস ধরে তাঁর একটি বাসা খালি পড়ে আছে।

মিরপুরের দক্ষিণ পাইকপাড়ার হাফিজউদ্দিন আহমেদ বাসা ভাড়া কমিয়ে দিয়েছেন। তবুও তাঁর দুটি ফ্ল্যাট আট মাস ধরে খালি পড়ে আছে। হাফিজউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার এলাকার অনেক বাসাই খালি পড়ে আছে। আমার দুটি বাসা খালি।

এপ্রিল-মে মাসে আমার পাঁচটি বাসা খালি হয়ে যায়। তিন মাস থেকে আট মাস পর্যন্ত তা খালি থাকে।’

ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারানে সুলতানের হিসাবে করোনার প্রভাবে দুই লাখ পরিবার ঢাকা ছেড়েছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনেকে কর্মহীন হয়েছেন, অনেকে বেতন ঠিকমতো পাননি। তাই রাজধানী ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন অনেক ভাড়াটিয়া। এ ছাড়া কেউ কেউ পরিবার গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সবকিছু চালু হলেও ঢাকা শহর স্থির হয়নি বলে জানান বাহরানে সুলতান। তিনি বলেন, তাই মানুষের অবস্থা এখনো আগের মতো না। তিনি এ পরিস্থিতিতে ভাড়া বৃদ্ধি না করার আহ্বান জানান।