করোনায় প্রতিবন্ধীদের জীবনে কান্না

আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে খুকি আক্তার। বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে
প্রথম আলো

প্রতিবন্ধী খুকি আক্তার এবার মাধ্যমিক পাস করেছে। তার বাবা-ভাইও প্রতিবন্ধী। মায়ের উপার্জনেই সংসার চলত। কিন্তু করোনার এই অতিমারিতে তাদের জীবন থমকে গেছে।

খুকি বলছে, করোনায় তার মা চাকরি হারিয়েছেন। তাই পরিবারের অবস্থা খারাপ। সে নিজে কলেজে ভর্তি হতে পারেনি। একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণকেন্দ্রে কাজ শিখছে, কিন্তু ভবিষ্যৎ অজানা।

খুকি যখন কথাগুলো বলছিল তখন বারবার ডুকরে কেঁদে উঠছিল। আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে খুকি এসেছিল এক সংবাদ সম্মেলনে। আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস উপলক্ষে এ আয়োজন করেছিল ডিজেবল রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন (ডিআরআরএ), লিলিয়ানা ফনস, কনসার্ন বাংলাদেশ, ইউকে এইড ও সিবিএম। সংবাদ সম্মেলনে খুকিসহ প্রতিবন্ধী বেশ কয়েকজন করোনাকালীন এই বিশেষ সময়ে তাঁদের জীবনের অভাব-অনটন ও প্রতিবন্ধকতার নানা দিক তুলে ধরেন।

প্রতিবন্ধী আশরাফুল আলম একটি ফার্নিচারের দোকানে কাজ করতেন। করোনায় তাঁর চাকরি গেছে, ছোট বোন টিউশনি করত, তা–ও ছুটে গেছে। বৃদ্ধ বাবা এখন আর কিছু করতে পারেন না। সংসার তাঁদের এখন চলে এর–ওর কাছে হাত পেতে।

আশরাফুল স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারেন না। দুঃখের কথা তিনি যখন বলছিলেন, তখন বারবার স্বর উঁচুতে উঠছিল। কান্না আর বেদনা ছিল সেই স্বরে। আশরাফুল একটি চাকরির জন্য আকুতি জানিয়েছেন, ছোট বোনের জন্য একটি টিউশনি। এতে তাঁর পরিবারের অভাব কিছুটা হলেও মিটবে বলে আশা করছেন।

গুলশানের একটি স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী শান্তা। অনটনের পরিবারে তার সমস্যা ভিন্ন রকম। অনলাইন ক্লাস হলেও শান্তা করতে পারছে না। যে পরিমাণ ইন্টারনেট ডেটা প্রয়োজন হয়, তা নিয়মিত কেনার সামর্থ্য শান্তার পরিবারের নেই। তাই ক্লাস হলেও শান্তার পড়া এগোচ্ছে না।

বাক্‌প্রতিবন্ধী তানিয়া আক্তার ইশারা ভাষায় বলছিলেন নিজের দুঃখগাথা। শব্দে গেঁথে তা তুলে ধরছিলেন আরেকজন। তানিয়া সেলাই আর পুঁতির টুকটাক কাজ করতেন। তা দিয়ে ‍সংসার খরচ কিছুটা ভাগ করে নিতে পারতেন। কিন্তু করোনার এই সময়ে আর আগের মতো কাজ পাচ্ছেন না। তাঁর স্বামী মুন্নাও বাক্‌প্রতিবন্ধী। চাকরি থাকলেও তাঁর বেতনে সংসার চলে না।

তানিয়ার সেই অভিব্যক্তি দাঁড়িয়েছিল এ রকম—‘আগে কাজ পেতাম। এখন কেউ কাজ দেয় না। সেলাইয়ের কাজ করায় না। আমাকে একটা চাকরি দেন।’ ইশারায় কথাগুলো বলতে গিয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন তানিয়া।

সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য পাঠ করেন ডিআরআরএর উপদেষ্টা স্বপ্না রেজা। তিনি বলেন, করোনাকালে থমকে পড়া বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিষয়টি গুরুত্বসহ বিবেচনার দাবি রাখে। হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ প্রতিবন্ধী। সে হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১ কোটি ৫ লাখ ৫৬ হাজার ৬৬৮ জন। এর মধ্যে আনুমানিক ১৬ লাখ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নিবন্ধিত, যাঁরা সরকারের ভাতা (৭০০ টাকা) পেয়ে আসছেন। এই চিত্রটা বলে দিচ্ছে এখনো প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর একটা মোটা দাগের অংশ নিবন্ধন ও সেবাপ্রাপ্তির বাইরে। আর ভাতা হিসেবে যা দেওয়া হচ্ছে, তা দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে জীবনযাপনের ব্যয়ভারের তুলনায় খুবই সামান্য। এমন অবস্থার মধ্যে করোনার আঘাত প্রতিবন্ধীদের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে।

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন, কনসার্ন বাংলাদেশের ডেপুটি টিম লিডার মেরী রশিদ এবং ডিআরআরএর নির্বাহী পরিষদ সদস্য কামরুল ইসলাম বক্তব্য দেন। এ ছাড়া সমকালের প্রধান প্রতিবেদক লোটন একরাম অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।