কুড়িয়ে পাওয়া সবজি বিক্রির টাকায় টিসিবির পণ্য কিনলেন রহিমা

টিসিবির পণ্য হাতে ষাটোর্ধ্ব রহিমা খাতুন। গতকাল ঢাকার আশকোনায়
ছবিঃ প্রথম আলো

প্রতিদিন ভোরে আজানের ধ্বনিতে ঘুম ভাঙে রহিমা খাতুনের। জীবিকার তাগিদে ষাটোর্ধ্ব এই নারীর দিনের শুরু তখন থেকেই। রাজধানীর দক্ষিণখানের আশকোনা হজ ক্যাম্প এলাকার বাসা থেকে হেঁটে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে বিমানবন্দর বাসস্ট্যান্ডে চলে যান। সেখান থেকে বাসে করে চলে আসেন কারওয়ান বাজারে। এখানে তাঁর কাজ মূলত বিভিন্ন আড়ত থেকে ফেলে দেওয়া ও রাস্তায় পড়ে থাকা আংশিক পচা সবজি কুড়িয়ে নিজের বস্তায় ভরা।

বস্তা পুরো ভরে গেলেই আবার বাসে করে ফিরে যান নিজের বাসায় (মেসে)। কুড়িয়ে পাওয়া আধপচা সবজির নষ্ট অংশ কেটে ভালো অংশটুকু আবার ব্যাগে ভরে বেরিয়ে পড়েন। বস্তির ঘরগুলোতে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেন সেই সবজি। এতে যা পান, তা দিয়েই চলে তাঁর সংসার। যেভাবে সবজি কুড়ান, সেভাবে সয়াবিন তেল, চিনি, ডাল সংগ্রহ করা যায় না। তাই রহিমা খাতুনকেও দাঁড়াতে হয় টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) পণ্যবাহী ট্রাকের লাইনে।

গতকাল শনিবার বেলা দেড়টায় রাজধানীর দক্ষিণখানের আশকোনায় হজ ক্যাম্পসংলগ্ন র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) কার্যালয়ের সামনে টিসিবির ট্রাক থেকে সাশ্রয়ী দামে পণ্য কিনতে যান রহিমা খাতুন। তবে প্রচণ্ড ভিড় ও হুড়োহুড়ির কারণে ঘণ্টাখানেক পর বুঝতে পারেন লাইনে দাঁড়িয়ে খুব একটা সুবিধা হবে না। পরে লাইন ছেড়ে পণ্যবাহী ট্রাকের এক পাশে গিয়ে টিসিবির পরিবেশকের বিক্রয় প্রতিনিধিদের কাছে গিয়ে বলেন তাঁকে তেল-ডাল দিতে। তাঁর কথা শুনে বিক্রয় প্রতিনিধিরা প্রথমে ভেবেছিলেন, তিনি হয়তো টাকা ছাড়াই পণ্য নিতে এখানে এসেছেন। যে কারণে তাঁকে এখান থেকে চলে যেতে বলেন।

মন খারাপ করে ঘটনাটি ট্রাকের একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক র‌্যাব সদস্যকে জানান রহিমা। পরে ওই র‌্যাব সদস্যের (নাম ও পদবি প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেছেন) সহায়তায় শেষ পর্যন্ত তিনি পণ্য কিনতে পারেন।

রহিমা খাতুন পণ্য নিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় প্রথম আলোকে বলেন, কুড়িয়ে পাওয়া সবজির ভালো অংশটুকু বিক্রি করে দিনে তাঁর আয় হয় প্রায় ৩০০ টাকা। নিজের অবস্থা সম্পর্কে বললেন, ‘আল্লাহ জানে কেমনে বাইচা আছি। সইলডা (শরীর) ভালা থাকলে কারওয়ান বাজার যাই, সবজি টুকাই আইনা বেচি। খারাপ থাকলে যাই না। তখন মাইনসের কাছে হাত পাতি।’

রহিমা খাতুনের স্বামী সালাম মিয়া মারা গেছেন। ছেলে আকবর মিয়া বিয়ে করে নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। আর মেয়ে শরিফা আক্তার শারীরিক প্রতিবন্ধী। আত্মীয়দের কাছে গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় রেখেছেন মেয়েকে। তিনি একাই আশকোনা হজ ক্যাম্পের কাছে অন্য নারীদের সঙ্গে একটি মেসে থাকেন। মেস ভাড়া দেন মাসে এক হাজার টাকা।

প্রতিবন্ধী মেয়েকে দেখতে ১০-১৫ দিন পরপর গ্রামে যান জানিয়ে রহিমা খাতুন বলেন, ‘যেগুলা কিনছি, এর অর্ধেক মাইয়ার জন্য নিয়া যামু। আর অর্ধেক নিজের লাইগা। কোনোমতে রোজাডা পার হইলেই চলব।’

গতকাল টিসিবির ট্রাক থেকে ৭৭০ টাকায় ২ কেজি করে মসুর ডাল, চিনি ও খেজুর, ২ লিটার সয়াবিন তেল ও ৩ কেজি ছোলা কিনেছেন রহিমা। পণ্য কেনার পর গতকাল তাঁর হাতে ছিল আর ৪৩০ টাকা।

আশকোনা হজ ক্যাম্প এলাকায় গতকাল পণ্য বিক্রি করেছে টিসিবির পরিবেশক মেসার্স খান জেনারেল স্টোর। সেখানে পণ্যবাহী ট্রাক পৌঁছায় বেলা দুইটার পর। সবকিছু গুছিয়ে বিক্রি শুরু হয় বেলা আড়াইটার দিকে। বিক্রির শুরুতে নারী ও পুরুষের পৃথক দুটি লাইনে দুই শতাধিক মানুষ ছিল। এর মধ্যে নারীদের লাইনে ছিলেন ১৩৩ জন। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লাইন আরও দীর্ঘ হতে থাকে।

পরিবেশকের বিক্রয় প্রতিনিধি মো. হ‌ুমায়ূন গত রাত সাড়ে আটটায় প্রথম আলোকে জানান, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে তাঁদের বিক্রি শেষ হয়েছে। ২৫০ জন পণ্য পেয়েছেন। খালি হাতে ফিরে গেছেন প্রায় ৬০ জন। এর মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি। তবে তাঁর দাবি, স্থানীয় বেশ কয়েকজন নারী জোট বেঁধে একাধিকবার লাইনে এসে পণ্য নিয়েছেন। তা না হলে প্রায় সবাই পণ্য পেতেন।

টিসিবির লাইনে চাকরিজীবী বাড়ছে

আশকোনা হজ ক্যাম্প থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে যাত্রাবাড়ীর ওয়াপদা গেট এলাকায় টিসিবির পণ্যবাহী ট্রাককে ঘিরে গতকাল ভিড় কিছুটা কম ছিল। সেখানে পুরুষদের লাইনে দাঁড়ানো ছিলেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী আমির হোসেন। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তিনি হাসনাবাদ এলাকাতেই থাকেন। গত বছরে চাকরি থেকে অবসরে যান আমির হোসেন। গতকালই প্রথম টিসিবির লাইনে দাঁড়ান তিনি।

ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর পণ্য কেনার সুযোগ পান অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী আমির হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পেনশন হিসেবে যে টাকা পান, তা দিয়ে এই বাজারে সংসার চালানো কঠিন। তাই বাধ্য হয়ে টিসিবির পণ্য কিনছেন।

যাত্রাবাড়ীর ওয়াপদা গেট এলাকায় গতকাল টিসিবির পরিবেশক ছিল মেসার্স হৃদয় জেনারেল স্টোর। এখানে পাঁচ পণ্যের প্যাকেজ বিক্রি হয়েছে ৯০০ টাকায়। এর মধ্যে ছিল দুই লিটার সয়াবিন তেল (২২০ টাকা), ৪ কেজি ছোলা (২০০ টাকা), ৩ কেজি খেজুর (২৪০ টাকা), ২ কেজি চিনি (১১০ টাকা) ও ২ কেজি মসুর ডাল (১৩০ টাকা)। পণ্য বিক্রি শুরু হয় দুপুর ১২টার দিকে। শুরুতে ভিড় কম থাকলেও পরে কিছুটা বাড়ে। বিক্রি শেষ হয় বিকেল চারটায়। লাইনে পণ্য কিনতে যতজন এসেছেন, তাঁদের সবাই পণ্য পেয়েছেন।

টিসিবির পরিবেশক শামীম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এখন অনেক চাকরিজীবী টিসিবির পণ্য কিনতে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন।